বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। দেশের ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারের অভিশপ্ত এক নাম। তিনি পুলিশের একজন সাবেক আইজি ও আওয়ামীলীগ সরকারের কিছু শীর্ষ ব্যক্তিদের পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাতে লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। মুলত আর্থিক খাতের সালমান এফ রহমানের পর দ্বিতীয় দরবেশ হিসেবে তিনি পরিচিত পেয়েছেন।

লুটপাটের আড়ালে ছিল ভয়ংকর জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ। মুলত চৌধুরী নাফিজ সরাফাত দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেস প্রাইভেট লিমিটেডের অন্যতম কর্ণধার। এই কোম্পানি ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করছে, যার তহবিলে আকার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

প্রসপেক্টাস ও আইন অনুসারে, ফান্ডগুলোর সর্বোচ্চ মেয়াদ ১০ বছর। কিন্তু শেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এগুলোর অবসায়ন হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে এগুলোর মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়িয়ে নিয়েছেন। তিনি আলোচিত পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান। ব্যাংকটির অন্যতম উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডারও তিনি। তিনি ব্যাংক বহিঃর্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সেরও প্রধান উদ্যোক্তা।

অন্যদিকে বিধিবিহর্ভূতভাবে বিএসইসির অনুমোদন না নিয়ে এসব ফান্ডের টাকায় চৌধুরী নাফিজ সরাফাত আলোচিত পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার কিনে পরিচালক বনেছেন। এছাড়া মাল্টি সিকিউরিটিজ নামে একটি ব্রোকারহাউজও কেনা হয়েছে এসব ফান্ডের টাকায়। ফলে বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালিত ফান্ডগুলোতে লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত বিরুদ্ধে।

যার ফলে সম্প্রতি বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এবং তার অধীনে পরিচালিত ফান্ডগুলোর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস ও তার অধীনে পরিচালিত ফান্ডগুলোর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলমান। তবে তাদের ব্যাংক হিসাব কেন স্থগিত করা হলো সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

বিএফআইইউর নির্দেশনায় বলা হয়, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানানো যাচ্ছে, আপনাদের প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এবং এর অধীনে পরিচালিত ফান্ডসমূহের সব ব্যাংক হিসাব, এফডিআর ও এমটিডিআর হিসাবসমূহের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২৩(১)(গ) ধারার আওতায় আগামী ৩০ দিনের জন্য অর্থাৎ ১০ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হলো।

বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালিত ফান্ডগুলো হলো: এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, রেস স্পেশাল অপরচুনিটিস ইউনিট ফান্ড, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড এবং রেস ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন ইউনিট ফান্ড।

এরই অংশ হিসেবে রেস পরিচালিত ফান্ডগুলোর অবস্থা খতিয়ে দখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। তদন্ত চলাকালীন এসব ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ যেন না থাকে, সে লক্ষ্যে বিএসইসির পক্ষ থেকে রেস ও তার ফান্ডগুলোর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার জন্য বিএফআইইউকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিএফআইইউ ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে।

চলতি বছরের গত ২৪ জুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এক নির্দেশে রেস পরিচালিত বিভিন্ন ফান্ডের অননুমোদিত সব বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব স্থগিত করেছে। এতে বলা হয়েছে, হেফাজতকারী বা কাস্টোডিয়ানের অনুমতি ছাড়াই রেস ম্যানেজমেন্ট বিভিন্ন ফান্ডের জন্য একাধিক বিও হিসাব খুলেছে, যা অবৈধ।

রেসের কার্যক্রম তদারকির জন্য বিএসইসি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে এ তথ্য মিলেছে। এ কারণে মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটধারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় অননুমোদিত এসব বিও হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ওই নির্দেশে, রেসের বিভিন্ন তহবিলের বিপরীতে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে অননুমোদিত যেসব বিও হিসাব রয়েছে, সেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তহবিলের ট্রাস্টিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে গত ৫ আগস্ট বিদেশে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ফলে ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক প্রাথমিক পর্যায়ে পদ্মা ব্যাংক দখল ও পুঁজিবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে।।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও পুঁবিাজারজ থেকে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া অভিযোগ আছে। তিনি আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা। এই দুই খাত ছাড়াও মোবাইলের টাওয়ার কোম্পানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি, তারকা হোটেল ব্যবসা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ নানা খাতে তার বিনিয়োগ আছে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের একজন সাবেক আইজি ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়ে তিনি ব্যাংক, পুঁজিবাজার ও অন্যান্য খাতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তার কাছে বিএসইসি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও ছিল অনেকটা জিম্মি।

সাবেক ফারমার্স (বর্তমানে পদ্মা) ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এরপরই পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকটির নাম পাল্টানো হয়। নাম দেওয়া হয় পদ্মা ব্যাংক।

এরপর তীব্র তারল্য সঙ্কটে বন্ধ হবার পথে থাকা পদ্মা ব্যাংক বাঁচাতে তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও আইসিবিকে পদ্মা ব্যাংকের ইক্যুইটিতে বিনিয়োগে বাধ্য করেন তিনি। ওই ব্যাংকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বড় অংকের আমানত রেখে ফেঁসে গেছে। চেয়ারম্যান হিসাবে পদ্মা ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর চৌধুরী নাফিজ সরাফাত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দণ্ড-সুদ, জরিমানা মওকুফসহ বিভিন্ন ছাড় পায় পদ্মা ব্যাংক। এরপরও ব্যাংকটি ধুঁকছে।

২০২৩ সালের শেষে পদ্মা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। ফলে ঋণ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ব্যাংকটি বড় অর্থের লোকসান গুনছে বলে জানা গেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

নাফিজ সরাফাত একাধিক ব্রোকার হাউজের মালিক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সর্বশেষ যেসব ট্রেক ইস্যু করেছে, তাতে নামে-বেনামে নাফিজ সরাফাতের ৩/৪টি ট্রেক রয়েছে বলে জানা গেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য শফিকুর রহমানের মালিকানাধীন একটি টেলিভিশনের শেয়ার লিখে জোর করে লিখে নেওয়ার আভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

শফিকুর রহমান এক লিখিত বক্তব্য বলেছিলেন, চার-পাঁচ বছর আগে সংসদ সদস্য শফিকুর রহমানকে রাতে তার বাসা থেকে তুলে হোটেল ওয়েস্টিনের নিচ তলায় পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে রুট গ্রুপের মালিক রাজ্জাকুল হোসেন টুটুল, নাফিজ সরাফাতসহ আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন।

শফিকুর রহমান আরও অভিযোগ করেছিলেন, এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণার মাধ্যমে শফিকুর রহমানের সই নিয়ে সিটিজেন টিভির শেয়ার হস্তান্তর করে নেয়া হয়। পরে শফিকুর রহমান জানতে পারেন তার নামে সিটিজেন টিভির ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে এবং বেনজীরের দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে যথাক্রমে ১৫ শতাংশ করে মোট ৩০ শতাংশ শেয়ার,

আরেকজনের নামে (অজ্ঞাত) ২৫ শতাংশ শেয়ার এবং টুটুনের নামে রয়েছে ১৫ শতাংশ শেয়ার। শফিকুর রহমানের ভাষ্যমতে চার-পাঁচ বছর পার হলেও তিনি এই বিষয়ে কিছু করতে পারেননি। একজন সংসদ সদস্য হিসাবেও তাদের কাছে তিনি ছিলেন অসহায়।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৩ জুন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. সরোয়ার হোসেন সিটিজেন টিভিকাণ্ডে সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন।