বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কারসাজি দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দীর্ঘদিন যাবত দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক অস্থিরতা এবং এর প্রতিকার নিয়ে গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিবেদনে পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নাম উঠে আসে।

এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পদত্যাগী চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, সাবেক কমিশনার শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানের নাম উঠে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন লঙ্ঘন করে সালমান এফ রহমানকে বন্ডের অনুমোদন দেওয়ায় দ্বিতীয়বার বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসাবে পুনঃনিয়োগ পান শিবলী রুবাইয়াত ইসলাম। প্রতিবেদনে বিএসইসির পরিচালক শেখ মাহবুব-উর-রহমান, সরকারি সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরু, তার প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাদবর, আলোচিত কারসাজিকারী আব্দুল কাইয়ুম, হিরুর প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংস, ক্রিকেটার ও সাবেক সংসদ-সদস্য সাকিব আল হাসান, বহুল বিতর্কিত ও যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকা নিষিদ্ধ ব্যবসায়ী জাবেদ এ মতিন এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট সায়েদুর রহমানের নাম উঠে আসে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করে সিআইডি এই প্রতিবেদন তৈরি করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সেরা ১০টি প্রতিবেদনের রেফারেন্স উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাজারে বেক্সিমকো গ্রীন সুকুক বন্ড ছেড়ে সালমান এফ রহমান ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। এক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ১০০ টাকা দরে ওই বন্ড কিনতে বাধ্য করা হয়। এছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের দাম ১০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সালমান। এতে সহায়তা করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সম্মতি না দিলেও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও তার চক্রটি অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে শেয়ার মার্কেটে দুর্বল কোম্পানি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, এস আলমের মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, শিকদার ইস্যুরেন্স, ক্যাপিটেপ গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড, এশিয়াটিক ল্যাব, বেস্ট হোল্ডিংসসহ বিভিন্ন দুর্বল কোম্পানির আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন দেয়।

এ প্রক্রিয়ায় বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে সহায়তা করেন শিবলী। এর ফলে মার্কেটে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়ে ধারাবাহিক পতন হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেয়ার মার্কেটে দুর্বল আইপিও অনুমোদন দিলে বিপুল অঙ্কের টাকা মার্কেট থেকে চলে যায়। এরপর সেকেন্ডারি মার্কেটে কারসাজি চক্রের তান্ডবে ধারাবাহিক পতন হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যান। এছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডকে ২ হাজার ৬শ কোটি টাকার জিরো কুপন বন্ড অনুমোদন দেন শিবলী রুবাইয়াত। এরপর বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসাবে শিবলী রুবাইয়াতের পুনঃনিয়োগে সরাসরি সহায়তা করেন সালমান এফ রহমান।

এছাড়াও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সম্মতি না দিলেও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও তার চক্রটি অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে শেয়ার মার্কেটে দুর্বল কোম্পানি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, এস আলমের মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, শিকদার ইস্যুরেন্স, ক্যাপিটেপ গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড, এশিয়াটিক ল্যাব, বেস্ট হোল্ডিংসসহ বিভিন্ন দুর্বল কোম্পানির আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন দেয়। এ প্রক্রিয়ায় বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে সহায়তা করেন শিবলী।

এর ফলে মার্কেটে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়ে ধারাবাহিক পতন হয়। শেয়ার মার্কেটে দুর্বল আইপিও অনুমোদন দিলে বিপুল অঙ্কের টাকা মার্কেট থেকে চলে যায়। এরপর সেকেন্ডারি মার্কেটে কারসাজি চক্রের তা-বে ধারাবাহিক পতন হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যান। এছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডকে ২ হাজার ৬শ কোটি টাকার জিরো কুপন বন্ড অনুমোদন দেন শিবলী রুবাইয়াত। এরপর বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসাবে শিবলী রুবাইয়াতের পুনঃনিয়োগে সরাসরি সহায়তা করেন সালমান এফ রহমান।

এছাড়া শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান এবং আবুল খায়ের হিরু মিলে বন্ধ থাকা কোম্পানি চালুর উদ্যোগ নেন। এরা অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে বন্ধ কোম্পানি চালু করার নামে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নিজস্ব লোকদের নতুন পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়ে বেশকিছু কোম্পানি দখল করেন। এরমধ্যে এমারেল্ড অয়েলের পর্ষদ ভেঙে মিনোরি বাংলাদেশকে মালিকানা দিয়ে শেয়ার কারসাজি করে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী ২০২২ সালে ঘোষণা দেন ডিএসইর সূচক ১০ হাজার পয়েন্টে উন্নীত হবে। প্রতিদিন লেনদেন ৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কেট ভালো না হলে ফ্লোর প্রাইস (নিুসীমা) তুলবেন না। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তার কথা বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করেন।

কিন্তু ধারাবাহিক পতনের মধ্যে বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়। এ সময়ে সূচক ৫ হাজার ২শ পয়েন্টে নেমে আসে। লেনদেন নেমে আসে মাত্র ৩শ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। এতে শিবলী রুবাইয়াত, শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ এবং আবুল খায়ের হিরু লাভবান হয়েছেন। আর ভুয়া তথ্যের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করেছেন।

শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, শেখ শামসুদ্দীন আহমেদের সহায়তায় বিএসইসি পরিচালক শেখ মাহবুব উর রহমান নিজ রুমে সার্ভেইল্যান্স সফটওয়্যার (নজরদারি সফটওয়্যার) অবৈধভাবে সংযোগ স্থাপন করে কারসাজি চক্রকে শেয়ার বাজারের অতি সংবেদনশীল গোপন তথ্য দিয়ে আসছিল। এই প্রক্রিয়ায় চক্রটি মিলে কোটি কোটি আত্মসাৎ করেছেন। বাজারে ধারাবাহিক পতনের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে কারসাজির ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম মো. আবুল খায়ের হিরু।

সেই হিরু সিন্ডিকেট ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংক, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রকৌশল খাতের বিভিন্ন শেয়ারের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে কারসাজির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে ডিএসই থেকে কারসাজির তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে পাঠানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে শিবলী রুবাইয়াত, শামসুদ্দীন, সাইফুর রহমান এবং শেখ মাহবুব-উর রহমানের সহযোগিতায় আবুল খায়ের হিরু, আব্দুল কাইয়ূম, জাবেদ মতিন এবং সায়েদুর রহমানসহ কারসাজি চক্র শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে দীর্ঘদিন কারসাজির পর নামমাত্র টাকা জরিমানা করে বিপুল টাকার বৈধতা দিয়েছেন রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ৪ বছরে বিএসইসিতে ১৮৪টি তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছে ডিএসই। কিন্তু আবুল খায়ের হিরুকে কয়েকটি কারসাজির মাধ্যমে নাম মাত্র জরিমানা করে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কর আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এছাড়াও অনৈতিকভাবে বিপুল সুবিধা নিয়ে একক সিদ্ধান্তে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩শ কোটি টাকার রূপান্তরযোগ্য বন্ড অনুমোদন দেন শিবলী। যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ইতিহাসে বিরল।

এদিকে কেস স্টাডি সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরো শুধু নামে নন, পুঁজিবাজারের অঘোষিত ‘হিরো’ বনেছেন। শেয়ার কারসাজি করে একদিকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, গড়েছেন সমাজের প্রভাবশালীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক। দু’বছর আগেও যাকে কেউ চিনত না, সেই তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো এমন জাদু দেখিয়েছেন, যার বদৌলতে হাজার হাজার মানুষ তো বটেই, দু-চারজন সেলিব্রেটিও ছুটছেন তাঁর পিছু পিছু।

সেই দলে আছেন সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, সম্পদশালী ব্যক্তি, ব্যাংকের মালিকসহ নানা পেশার মানুষ। তাঁর হাতে আছে রাতারাতি ধনকুবের হওয়ার অত্যাশ্চর্য জাদুর কাঠি। সেই কাঠির ছোঁয়ায় আগাগোড়া বদলেছেন হিরো। হিরোর ছায়ায় থেকে পাল্টেছে অনেকেরই জীবনের রং। আবার অনেকে পথে বসেছেন। ফলে হিরুর চলছে ওপেন কারসাজি, হিরু’র আইটেম হলেই মাসের মধ্যে দাম দ্বিগুন হয়ে যায়। আর যখন বিনিয়োগকারীরা ঐ শেয়ারে ঝুঁকে পড়ে তখন হিরু বিক্রি করে বের হয়ে যায়।

তাই পুঁজিবাজারে এক বছরের বেশি সময় ধরে গুঞ্জন ছিল আর্থিক খাতের কোম্পানি আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছে। কোম্পানিটির ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থার উন্নতির কারণে নয়, বরং কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বেড়েছে। পরে তদন্ত সাপেক্ষে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় এনেছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদের দেড় কোটি টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। সম্প্রতি নিয়মিত কমিশন সভায় আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কমিশন জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে চলতি বছরের আগস্টে বিডিকম অনলাইন, ওয়ান ব্যাংক, ফরচুন শু, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক,

এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ও ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে আবুল খায়ের হিরুসহ তার সহযোগীদের (স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, বোন কনিকা আফরোজ, শ্যালক কাজী ফরিদ হাসান, তার কোম্পানি মোনার্ক হোল্ডিং, ডিআইটি কো-অপারেটিভ এবং দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট) মোট ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। আবুল খায়ের সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার। ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি এ পদে যোগ দেন।

দ্বিতীয় কেস স্ট্যাডি ২০২১ সালের ৬ মে। ১১.২৬ মিনিট ৮ সেকেন্ড। পরবর্তী ২৯ সেকেন্ডে দেশের প্রধান পুঁজিবাজারে এক অস্বাভাবিক লেনদেন লক্ষ্য করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। ১১.২৬ মিনিট ৮ সেকেন্ড থেকে ৩৭ সেকেন্ড পযন্ত আইটি খাতের ইজেনারেশন লিমিটেডের লেনদেন হওয়া তিন লাখ ২৩ হাজার ৭২৯টি শেয়ারের মধ্যে দুই লাখ ১৭ হাজার ৩১০টি শেয়ারই পাঁচটি বিও একাউন্ট থেকে। এই ২৯ সেকেন্ডে ৪৩ টাকা থেকে ৪৫ টাকা ৩০ পয়সায় চলে যায় শেয়ারটির মূল্য। ৬ মে দিনশেষে শেয়ারটির মূল্য বৃদ্ধি পায় ৪ টাকা ১০ পয়সা অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টদের অবাক করে দেয় এ ধরনের লেনদেন। এ লেনদেন থেকেই বোঝা যায় আবারও অস্থিরতায় পড়েছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার। আজ উত্থান তো কাল পতন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে কারসাজি চক্র। ২০২০ সালের ১৭ মে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়। এরপর ধীরে ধীরে গতি পায় বাজার। তরতর করে বাড়তে থাকে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দর। বিনিয়োগকারীরাও নড়ে চড়ে বসেন। লেনদেন বাড়তে থাকে। বাড়ে সূচকও। শুরু হয় কারসাজি। মূলত কারসাজির কারণেই শেয়ারবাজারের গতি বাড়তে থাকে। শেয়ারবাজারের নিয়ে কারসাজি করে রাতারাতি তারকা বনে যান নতুন নতুন খেলোয়াড়।

বর্তমান পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টরা বলতে শুরু করেছেন বাজারে গেমলার না থাকলে গতি আসে না। লেনদেন বাড়ে না, বাড়ে না সূচক। কিন্তু যখন দর পতন ঘটে তখন বিপর্যয় নেমে আসে বিনিয়োগকারীর জীবনে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তারা। মিছিল, মিটিং আর বিক্ষোভ। রাজপথে আগুন জ্বালিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। শেয়ারবাজারের এই উত্থান পতনের সঙ্গে এক ধরনের কারসাজি জড়িত বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

কারসাজির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই নজর রাখছিল দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ। বিস্ময়কর এই লেনদেন নিয়ে তদন্তে নামে ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জ ( ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ হাতে এসেছে ডিএসই’র করা তদন্ত প্রতিবেদনটি। ২০১০ সালের ধসের আগে পুঁজিবাজারে যে ধরনের কারসাজি চলেছিল এবারও সে লক্ষণ স্পষ্ট। তবে এবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আগে থেকেই সক্রিয় হয়েছে। সে কারণে বিভিন্ন কারিসাজি নজরে আসার পরপরই তদন্তের ব্যবস্থা করছে।

শুধু ৬ মে নয়। ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে চলা ই-জেনারেশনের শেয়ার লেনদেন নিয়ে চলেছে সিরিয়াল ট্রেডিং। ওই নির্দিষ্ট সময়ে শেয়ারটির সর্বোচ্চ ক্রেতা ছিলেন মোহাম্মদ আবুল খায়ের ( বিও আইডি নম্ব র ১২০১৯৫ —– ৬৪৫৩৫) , শেয়ারটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রেতা ছিলেন মাহমুদ উজ জামান চৌধুরী ( বিও আইডি ১২০৩৬৩ —– ২৪৪৮৭), তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্রেতা হলেন ডি আই টি কো-ওপারেটিভ লিমিটেড ( বিও আইডি ১২০৫৫৯ —— ৫৭৮১১)।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্যে দেখা গেছে, ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ডিএসইর সূচক ১৮ দশমিক ০৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একদিনে ৫১৭৭.৪৮ পয়েন্ট থেকে ৯৫০.১৪ বেড়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬০০৮.৬৯ পয়েন্টে পৌঁছায়। এরপর থেকে দেশের পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক উত্থান ও পতন শুরু হয়। গত এক বছরে ই-জেনারেশনের প্রতিটি শেয়ারের দর ১৫ টাকা থেকে বেড়ে সর্বোচ্চ ৬৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে।

ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের চার কর্মকর্তা নিয়ে গঠিত ডিএসইর তদন্ত কমিটি ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ই-জেনারেশনের লেনদেন ধরে তদন্ত করে। তদন্ত রিপোর্ট মতে গত ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে শেয়ারটির মূল্য বেড়ে ১১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। তদন্তে দেখা, গেছে ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ই-জেনারেশন লিমিটেডের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পায়। এই দর বৃদ্ধির পর থেকেই এখনও শেয়ারটির দর বৃদ্ধি অস্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। ডিএসইর ওয়েবসাইট থেকে দেখা গেছে ৫ আগস্ট এর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ৬৮ টাকায়।

দরবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে দুটি গ্যাং-এর সিরিয়াল ট্রেডিং বা ধারাবাহিক লেনদেন। পুঁজিবাজারে একজন বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে আলোচনায় আসেন আবুল খায়ের ওরফে হিরু। তিনি সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সমালোচকরা সরকারি এই কর্মকর্তাকে কারসাজির চক্রের মহানায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। বর্তমান শেয়ারবাজারের সূচক ও লেনদেন ওঠানামার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে হিরু গং এর নাম। গত চার বছরে সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে এতো টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন যে এ বছর বিপিএল এ রানার্ আপ হওয়া ক্রিকেট দল ফরচুন বরিশালের সত্বাধিকারী হয়েছেন তিনি।

তদন্তে জানা গেছে, মোহাম্মদ আবুল খায়ের ওরফে হিরু নিজের একটি, স্ত্রীর দুটি এবং তার নিয়ন্ত্রাধীন ডি আই টি কো ওপারেটিভ লিমিটেডের নামে দুটি বিও একাউণ্ট থেকে এ লেনদেন করেন। ৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে এই ৫৬ দিনে ৫ টি বিও একাউন্ট দিয়ে কোম্পানির লেনদেন হওয়া শেয়ারের ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করে আবুল খায়ের অ্যান্ড গং। এসময়ে আবুল খায়ের ওরফে হিরু ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ১৭৩ টি শেয়ার কিনেছেন। তাতে মুনাফা হয় ২ কোটি ৩২ লাখ ৫ হাজার ৬০৮ টাকা। এসময় ইজেনারেশনের ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৬ টি শেয়ার লেনদেন হয়।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ সুযোগে কারসাজি চক্র হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছে। গত ১৫ বছর বিএসইসি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ২০০৯-২০১০ সালে পুঁজিবাজারের পতনের পর লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যান। শেয়ার ক্রয়ে মার্জিন ঋণ প্রদানকারী বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়।

এর পর থেকে বাজার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় বারবার ক্ষতির মুখে পড়ে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়ে চলে যান। বাজার পতনের কারণ ও দোষীদের খুঁজে বের করতে তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা বাজার কারসাজিতে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলশ্রুতিতে সেই কারসাজি চক্র আরো সক্রিয় হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর পর্যায়ক্রমে এম খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা উভয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা থেকে এসে এই পদে আসীন হন। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের অপেশাদার এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বাজারের কোনো উন্নতি হয়নি, বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে এসে পৌঁছায়। এ সিন্ডিকেট চক্রের কিছু সদস্য পুঁজিবাজারকে লুটপাট করেছে। এদের বিচার দাবী জানিয়েছেন তিনি।