দুদকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে মাফিয়া ডন বদিউজ্জামান!
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ চোরাচালানের রুটের নিয়ন্ত্রণ মাফিয়াদের হাতে। স্বর্ণ চোরাকারবারির পাশাপাশি ভয়ংকর মাদক ইয়াবা পাচার হয়। স্বর্ণ ও মাদক পাচারের অর্থ হণ্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়। স্বভাবতই এই মাফিয়াদের হাতে স্বর্ণ চোরাচালানের রুটের নিয়ন্ত্রক ছাড়াও হণ্ডির লেনদেনের একটি হিসাব রয়েছে। এই হিসাবে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা হণ্ডিতে লেনদেন হয় এই মাফিয়াদের হাতে। এক্ষেত্রে হণ্ডির সঙ্গে নিয়ন্ত্রক গ্রুপ আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি মাফিয়া হিসাবে পরিচিতি পায়।
মুলত এম বদিউজ্জামান। ব্যাংকার থেকে হন্ডি ব্যবসায়ী। পরে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। ১/১১-এর পর থেকে ২০২২ পর্যন্ত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরে জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে দুদকে মামলা হওয়ায় গা ঢাকা দেন। আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যবহার করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া এম বদিউজ্জামান এখন লোকচক্ষুর আড়ালে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক অভিযোগের পাশাপাশি দুদক পক্ষ থেকে দুইটি মামলাও রয়েছে। অভিযোগ ও মামলায় বদিউজ্জামানের দুই স্ত্রী, ছেলেসহ ৬ জনের নামও রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এম বদিউজ্জামান সিঙ্গাপুরে লুকিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে পাচারের টাকায় সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছেন নিজের সাম্রাজ্য। সিঙ্গাপুরের ৩নং রোবার্টস রোডে বদিউজ্জামানের জামান সেন্টারে হোটেল সিঙ্গাপুর ইন পরিচালনার পাশপাশি স্বর্ণ ও অর্থ পাচার করেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে যাতায়াতকারী অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাকে হন্ডি জামান নামেই চেনেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তার কাছে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা আশ্রয় নিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র জানায়।
সূত্র জানিয়েছে, বেনজীরের আহমেদের অধিকাংশ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বদিজ্জামানের হাত হয়ে। তিনি বেনজিরের একাংশের ব্যবসায়িক পার্টনারও ছিলেন বলে মোনা যায়। এসব অভিযোগ সম্পর্কে এম বদিউজ্জামানের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, এম বদিউজ্জামান তার দুই ছেলে নাফিহ রশিদ খান ও নাভিদ রশিদ খান এবং বদিউজ্জামানের দুই স্ত্রী নাসরিন জামান ও তৌহিদা সুলতানাসহ তার আত্নীয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের শেয়ার ক্রয়সহ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের আমলযোগ্য তথ্য-প্রমাণ থাকায় দুদক কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ দুইটি মামলা করা হয়।
দুদক সূত্র আরো জানিয়েছে, শুধু শেয়ার কেনাবেচায় অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এম বদিউজ্জামান ও সহযোগীরা । এম বদিউজ্জামান অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অ্যাডভান্স হোম প্রাইভেট লিমিটেড ও ফিনিক্স লিমিটেডের বিপুল অঙ্কের শেয়ার কেনা, মানি লন্ডারিং করেছেন। এছাড়াও কালো টাকার ব্যবসায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন সহকারি পরিচালক জানান, ২০২২ সালে এম বদিউজ্জামান বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুত্বর অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে দুইজন সহকারি পরিচালক ব্যাপক অনুসন্ধান চালান। প্রাথমিকভাবে তারা অভিযোগের তথ্যের সত্যতার প্রমাণ পান। যার পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের ঐ দুজন সহকারি পরিচালক বাদী হয়ে বদিজ্জামানের বিরুদ্ধে একটি মামলা এবং তার স্ত্রীসহ আরো ৬ জনের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা করেন। বিষয়টি নিয়ে এখনো আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এম বদিউজ্জামানের বাংলাদেশে কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। তারা মূলত বিভিন্ন কৌশলে হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে টাকা পাঠায়। দেশ থেকে যারা বিদেশ টাকার পাচার করতে চাই এ সকল ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ৫ থেকে ১০% কমিশনের চুক্তি করে তারা । পরে সেই মোতাবেক তারা বাংলা টাকা বুঝে নিয়ে সিঙ্গাপুরী ডলার বা ইউএস ডলার বুঝিয়ে দেয়।
সিঙ্গাপুরসহ একাধিক দেশে হুন্ডি ব্যবসার অন্যতম অংশীদার বদিউজ্জামানের স্ত্রী তানিয়া জামান। সার, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির নামে ওভার ইনভয়েস করে অর্থ পাচার করেন। এসবের এবিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) রয়েছে একাধিক প্রমাণ।
এছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে যারা দেশে ফিরে বদিউজ্জামান (হন্ডি জামান) তাদের প্রলোভনে ফেলে স্বর্ণ চোরাচালান করে দেশে। প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় কখন কখন বিমানের অর্ধেক ভাড়া প্রদান, আইফোন উপহারসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানে বাধ্য করেন। তার এ কাজের সহযোগী করেন সিঙ্গাপুরে স্থানীয় আরভিন রাথোর নামের একজন সহযোগী। এছাড়াও রাজধানীর ঢাকার তাঁতী বাজারের কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে দেদারছে স্বর্ণ পাচার করে যাচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বদিউজ্জামান ও স্ত্রী ও ছেলেদের নামে বসন্ধুরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে তিনটি প্লট। গুলশানে রয়েছে একটি ফ্লাট। বনানীতে রয়েছ হুতল ভবন। জোয়ারসাহারায় রয়েছে দুইটি ৯ তলা আবাসিক ভবন। উত্তরায় বহুতল ভবন। গোপালগঞ্জ জেলা সদরে প্রায় ৩৫০ বিঘা জমিতে রয়েছে দুউটি আবাসিক প্রকল্প। গোপালগঞ্জ সদরে সার্কিট হাউস রোডে রয়েছে নিজের নামে বিলাসবহুল আবাসিক বাড়ি। এছাড়াও বিভিন্ন বাণিজ্যিক এলাকায় তারা নানা প্লট, ফ্ল্যাট, জমি-জমা সম্পত্তি কিনেছেন। নামমাত্র জামানতের বিপরীতে শত শত কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়ে নরসিংদীতে বিশাল আকারের ফ্যাক্টরি ও খামার গড়ে তুলেছেন। নামে-বেনামে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন। জাহাজের ছোট ছোট বোট চালানোর ডকইয়ার্ডও রয়েছে তাদের।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানান, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে সিআইডি । এম বদিজ্জামানের একটি ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালিন তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ ছিল। যেহেতু তার বিষয় নিয়ে দুদক কাজ করছে। প্রয়োজনে দুদককে সহযোগীতা করতে ইন্টাপোলের মাধম্যে দেশে ফিরে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এই বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতিনিয়ত সুকৌশলে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অপরাধীরা কোনো ডকুমেন্টেশন রাখে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, দুদকের উচিত যে কোনো মূলে বিচারের মুখামুখি করা। তথ্য প্রমাণ ও মামলা থাকার পরও সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে অপরাধীরা বিদেশে পালাতে সক্ষম হচ্ছে। তাই দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরো নজরদারি বাড়াতে হবে।
গোপালগঞ্জের একজন আত্নীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এম বদিউজ্জামানের সঙ্গে এলাকার মানুষ জনের সম্পর্ক ভালো না। এলাকার বেশ কয়েক যুবকদের চাকুরী দেয়ার নাম করে বিদেশে নিয়ে গেছে। কিন্তু কাজ না পেয়ে তাদের দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। এছাড়াও তার প্রলোভনে পড়ে অনেকেই বিদেশে গেছে। গোপালগঞ্জ সদরে তার বহুতল একটি ভবন রয়েছে। সেখান থেকে তিনি শেখ সেলিমকে দুইটি ফ্লোর উপহার দিয়েছেন, এটা এলাকার সবাই জানে। এখন তার আত্নীয় হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।