মহসিন সুজন, দেশ প্রতিক্ষণ, বরিশাল: নিজস্ব ব্যবসা ও মুনাফায় থাকা ফরচুন সুজ হঠাৎ করে পুঁজিবাজারে আলোচনায় উঠে আসে হিরু চক্রের কারসাজির মাধ্যমে। অথচ কোম্পানির সুনাম ছিল জুতা ব্যবসায়। পুঁজিবাজারে কোম্পানিটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে ১০ টাকা করে শেয়ার ছেড়ে তালিকাভুক্ত হয়। শুরুতে দর ভালো থাকলেও এক পর্যায়ে কোম্পানিটির দর ২০ টাকায় নেমে আসে। তখনই নজর পড়ে আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী আবুল খায়ের হিরুর। হিরুর স্পর্শে প্রতিটি শেয়ারের দর সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা ওপরে উঠে যায়। এরপরে পুঁজিবাজারে কারসাজির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় কোম্পানিটি। হিরুর সঙ্গে তৎকালীন বিএসইসির সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তির ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

উল্টো কারসাজিকারকদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। সবপক্ষ মিলে সহযোগিতার অংশ হিসেবে ফরচুন সুজের নিজস্ব পোর্টফলিওতে কারসাজিকারদের আইটেমে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। ছোট-বড় ব্যবসায়ী, কারসাজিকারক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা একযোগে নেমে পড়ে কোম্পানিটিকে ঘিরে কারসাজির জন্য। যদিও শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়া ও ভুয়া সম্পদ দেখানোর অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই।

এ কারণে গত ১ সেপ্টেম্বর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন বিএসইসি ফরচুন সুজ লিমিটেড সংক্রান্ত পুঁজিবাজারের যাবতীয় অনিয়ম ও কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণ সংক্রান্ত অনিয়ম এবং কোম্পানিটির শেয়ার মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

মুলত বরিশাল বিসিকে স্থাপিত কোম্পানিটি গত ২০১৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিটি ২২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এ কোম্পানিটির শেয়ার দর ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিলের আগপর্যন্ত ৩০ টাকার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। তবে ২২ এপ্রিলের পর তা টানা বাড়তে শুরু করে। যার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পায় না ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ফরচুন সুজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তবে তিনি বর্তমানে তুরষ্কে অবস্থান করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

জানা যায়, ফরচুন সুজ ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে নিদিষ্ট সময় বিতরণ না করায় ডিএসইতে অভিযোগ দিয়েছিলেন বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ৯ জুন ওই লভ্যাংশ বিতরণ করেছে বলে ডিএসই জানায়। তবে কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের লভ্যাংশ এখনো বিতরণ করেনি।

এদিকে ২০১৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। সর্বশেষ ৩ অক্টোবর কোম্পানিটির শেয়ার ডিএসইতে ১৮ টাকা দরে লেনদেন হয়। ওইদিন শেয়ারটির দর ৪০ পয়সা বা ৪.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত ১ বছরে শেয়ারটির দর ১৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৭৫ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত উঠানামা করে।  কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ,২৪) কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি আয় করেছে ০৬ পয়সা। ২০২৩ সালে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

সূত্র মতে, ফরচুন সুজের ৫০ লাখ শেয়ার কিনে বড় লোকাসানে পড়েছে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। জেনেশুনে তুলনামূলক দূর্বল মৌলের এসব শেয়ার উচ্চ মূল্যে কিনেছিল আইসিবি। অভিযোগ আছে, কারসাজিকারীদের সুবিধা দিতে তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব শেয়ার কিনেছিল তারা। মুলত ২০২২ সালের ৯ মে ১২৪ টাকা ২৩ পয়সা দরে ফরচুনের ২৫ লাখ শেয়ার কিনে আইসিবি। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আরও ২৫ লাখ শেয়ার কেনা হয় ৭৯ টাকা ৬৬ পয়সা দরে।

অর্থাৎ দুই দফায় কেনা ফরচুন সুজের ৫০ লাখ শেয়ার কিনেছে আইসিবি, যার গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০১ টাকা ৯৪ পয়সা। এতে আলোচ্য শেয়ারের দাম পড়েছে ৫০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এতে আইসিবির কেনা ৫০ লাখ শেয়ারের দাম কমে মাত্র ৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। এর ফলে ফরচুন সুজে বিনিয়োগ করে আইসিবির লোকসান হয়েছে ৪১ কোটি ৫২ লাখ টাকা।