শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ক্রমেই নাজুক হচ্ছে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি। দিন যতই যাচ্ছে পুঁজিবাজারের পতনের আকারও তত বড় হচ্ছে। ফলে ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। চলছে ব্যাপক রক্তক্ষরণ। অস্থিরবাজারে প্রায় প্রতিদিনই মূল্যসূচক কমছে। এরচেয়েও বেশি কমছে শেয়ারের দাম। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের অনেকেই যে কোনো মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যেতে মরিয়া। তাতে বাজারে বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে।

অন্যদিকে দেখা দিয়েছে ক্রেতার অভাব। প্রায় প্রতিদিনই লেনদেনের এক পর্যায়ে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার ক্রেতা-শুন্য হয়ে পড়ছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগকারী নন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্বিগ্ন। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে।

এছাড়া টানা দরপতন অব্যাহত থাকায় পুঁজিবাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে প্রতিদিনই পোর্টফোলিও থেকে পুঁজি উধাও হয়ে যাচ্ছে। লাভের হিসাব বাদ দিয়ে প্রতিদিন কত লোকসান হচ্ছে, সেই হিসাব কষতে হচ্ছে ছোট-বড় সব ধরনের বিনিয়োগকারীর। ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেও আসছে না কাঙ্খিত ফল। ফলে বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ।

এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্র্বতী সরকার। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তিন কার্যদিবস পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন দেখা দিলেও অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পতনের পাল্লা ভারী হয়েছে।

ফলে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন দেখা দিলে সম্প্রতি একাধিক দিন রাস্তায় মেনে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়েও দেন একদল বিনিয়োগকারী। সেই সঙ্গে বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন তারা। বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করলে পুঁজিবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং লেনদেন কমে ফের তলানিতে নামল পুঁজিবাজার।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী প্রভাষক হোসাইন আলী কাজী বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান মুল সমস্যা আস্থা সংকট। আস্থা সংকটের কারনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। আস্থা সংকট না কাটলে বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবো। কারণ টানা দরপতনের কারনে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী বাজারবিমুখ হয়ে পড়ছেন। এছাড়া এমন বাজারের চিত্র ৩০ বছরের ইতিহাসেও দেখিনি।

স্টক অ্যান্ড বন্ডের বিনিয়োগকারীরা মানিক মিয়া আহাজারী করে বলেন, ‘অদ্ভুত’ এমন পুঁজিবাজার ৩০ বছরের মধ্যে দেখিনি। টানা দরপতনে আমাদের পুঁজি শেষ হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোন ভুমিকা নিচ্ছে না। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে পুঁজিবাজার সংস্কার করা হচ্ছে। আসলে বাজার স্থিতিশীল না করে কী ভাবে সংস্কার করে পুঁজিবাজার এমন প্রশ্ন বিনিয়োগকারীদের।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, পুঁজিবাজারে উত্থান ও পতন থাকবে। কিন্তু আমাদের বাজারে নিয়মিত দরপতন চলছে। এটি স্বাভাবিক বাজারের বৈশিষ্ট্য নয়। এছাড়া টানা দরপতন পরিকল্পিত কোন কারসাজি কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ কেন দরপতন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কারণ স্বৈরাচার সরকারের প্রেতাত্মারা নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটিয়ে বর্তমান অর্ন্তর্বতী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে কিনা তাও দেখার বিষয় বলে মনে করছে তারা।

এদিকে সপ্তাহজুড়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সব সূচকের পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন হয়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে টাকার অংকে লেনদেনের পরিমাণ। এছাড়া সপ্তাহ ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ডিএসইর সাপ্তাহিক হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, বিদায়ী সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইতে বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। আর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে লেনদেন শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৯ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ০ দশমিক ৭৮ শতাংশ বা ৫ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।

গত সপ্তাহের তুলনায় ডিএসইর সব সূচকও কমেছে। চলতি সপ্তাহে প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬৪ দশমিক ০৮ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। এছাড়া ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৫৪ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর ডিএসইএস সূচক কমেছে ৩১ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

সূচকের পতনের সঙ্গে ডিএসইতে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ২৭২ কোটি ২ লাখ টাকা। এর আগের সপ্তাহে মোট লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৬৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এক সপ্তাহে লেনদেন কমেছে ১৯৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৪টি কোম্পানির, কমেছে ৩৪৫টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৭টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।