এনআরবিসির চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের অনিয়ম তদন্ত করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অনিয়ম জালিয়াতির স্বর্গরাজ্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি এনআরবিসি ব্যাংক। একের পর এক অপরাধ করে তা লুকিয়ে রেখেছে ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। অনিয়ম আড়াল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্ত করে আসছিল দুর্নীতিবাজ চক্রটি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অপরাধের দায়ে ব্যাংকটিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময়সীমা বেধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংক সুত্রে জানা যায়, ব্যাংকটির আলোচিত চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের ইশারায় এসব অপকর্ম চালিয়ে আসছে তারই তৈরি বিশেষ গ্যাং। বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের বলয়ে শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে তমাল।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং তার অনুসারী কয়েকজন চিহ্নিত অপরাধীর সমন্নয়ে বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে কর্মকর্তা ও অংশীজনদের জিম্মি করে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া হতো। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ভগ্নিপতি সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে কোন প্রকার অভিজ্ঞতা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে অনিয়মের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
আরেক সাবেক গভর্নর ফজলে কবীরকে নানা সুবিধা দিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল তমালচক্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক তদন্ত এবং একাধিক নথিপত্র পর্যালোচনা করে এসব তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। বোর্ড সভায় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ এবং বিপুল অর্থ অপচয়ের প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে।
ফলে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম পারভেজ তমালের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। দেশের পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাতে নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এবার ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্ত করতে মাঠে নামতে যাচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে সেটা তদন্ত করা হবে।
আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে, ব্যাংক কোম্পানি আইনে সুনির্দিষ্ট একটি কার্যধারা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে পারে না। সুনির্দিষ্ট কার্যধারার একটি হলো- অভিযোগ আমলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেকশন ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে পরিদর্শন কার্যক্রম নিশ্চিত করা।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাত ও আমানতকারীদের জন্য সেই অনিয়ম কতটা ক্ষতিকারক তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে। এরপর সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে অভিযুক্তর কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়। জবাব পাওয়ার পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটিতে একটি শুনানি হয়। এসব কিছু নিশ্চিত হওয়ার পরেই একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
উল্লেখিত এই প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যে পরিমাণ সময় দরকার সে পরিমাণ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিবে বলেও জানানো হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে দেশের পুঁজিবাজারে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে পারভেজ তমাল।
অভিযোগ রয়েছে, এনআরবিসির চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল, সাকিব আল হাসান, জাভেদ এ মতিন, ফরচুন শুজের মিজানুর রহমান ও আদনান ইমামরা ছিলেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে গড়ে ওঠা চক্র। কারসাজির মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্ন শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরেও কেন এনআরবিসির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না-এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে প্রত্যেকটা ব্যাংক নিয়ে কাজ করবে। এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১১টি ব্যাংক নিয়ে কাজ করছে, বিশেষ করে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো নিয়ে। এনআরবিসি ব্যাংকের বিষয়টি বিশেষভাবে নোট রাখলাম। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলবো, যাতে করে তরান্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগনামা এখনো দাখিল হয়েছে বলে জানা নেই। যদি হয় স্টাফ রেগুলেশনে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেনামে অনেক অভিযোগ আসে। আমাদের এইচ আর সেটা খতিয়ে দেখে। গর্ভনর বরাবর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না এলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। যারা বিভিন্ন ব্যাংকে পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিলেন তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে এটা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না।
এদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে আমরা তারল্য সহায়তা দিচ্ছি। এই সহয়তার পরিমাণ হয়তো আরো বাড়াতে পারি। তবে সব গ্রাহক একসাথে গেলে কোনো ব্যাংকের পক্ষে টাকা দেয়া সম্ভব না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপরিকল্পনা আছে। সব আমানতকারীদের আহবান করছি প্রয়োজনের বেশি টাকা আপনারা তুলবেন না। আমরা আস্থা ফেরাতে চাই। একইসঙ্গে ব্যাংকের টাকা নিয়ে গ্রাহকদের আতঙ্কিত না হতে বলেন তিনি।
তিনি বলেন, পাচার করা অর্থ ফরমাল চ্যানেলে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করবে। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হলে সেটা তদন্ত করা কঠিন। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। তবে এসব বিষয়ে বিএফআইইউ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য শেয়ার করে না। ঋন অনিয়ম নিয়ে কাজের অগ্রগতি বিষয়ে তিনি বলেন, আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ ইতিমধ্যে অনেক ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। এ বিষয়েও তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কোনো তথ্য দেয়নি।