জলবায়ু ঋণের জালে আটকে এলডিসি দেশগুলো: সিডিআরআই ২০২৪-এ অর্থনৈতিক সংস্কারের আহ্বান
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাকু, আজারবাইজান: চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ (সিআই) এর প্রবর্তিত জলবায়ু ঋণ ঝুঁকি সূচক ২০২৪ (সিডিআরআই) বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের কাঠামোতে আমূল পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন, শতভাগ ঋণমুক্তি, এবং প্রকৃতি-ভিত্তিক অর্থনীতিই এই সংকট উত্তরণের মূল চাবিকাঠি।
সিডিআরআই-এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য বিপদের মুখে। মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা শীর্ষ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে মাদাগাস্কারের সিডিআরআই স্কোর ৮১.৪১ এ পৌঁছাবে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ২০টি দেশের মোট জলবায়ু ঋণ সর্বোচ্চ ছিল ২.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০১৪) সালে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও তা উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে। সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ ২০০৯ সালের ০.৮৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ২১.২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২৪ গুণ বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
বাংলাদেশ এবং মালাওই, যারা “উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ” তালিকায় রয়েছে, ক্রমবর্ধমান সিডিআরআই স্কোরের সম্মুখীন হচ্ছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার উপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। বিশেষত বাংলাদেশের প্রতি নাগরিক জলবায়ু ঋণের বোঝা ৭৯.৬১ মার্কিন ডলার, যা দেশের পরিবেশগত দুর্বলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ঝুঁকির অসামঞ্জস্যতা নির্দেশ করে। দেশের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই) স্কোর ২৮.৩৩, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের প্রতি উচ্চ সংবেদনশীলতার প্রতিফলন।
অন্যদিকে, ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নাকম) গত দুই দশকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার আলোকে তথ্য তুলে ধরেছে। এই তথ্যগুলো ১৪ নভেম্বর ২০২৪, বাকুতে অনুষ্ঠিত সিআই ও নাকম এর যৌথ আয়োজনে এক সাইড ইভেন্টে আলোচিত হয়।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম. জাকির হোসেন খান, তার বক্তব্যে জলবায়ু অর্থায়নে লোভনীয় অর্থনীতির পরিবর্তে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী আর্থিক কাঠামোকে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে সংস্কার করা জরুরি। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০% অনুদানভিত্তিক অভিযোজন তহবিল চালু করা এবং ‘ডেট ফর ক্লাইমেট সুয়াপ’-এর মাধ্যমে ঋণমুক্তি নিশ্চিত করা হলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো টেকসই বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে পারবে।” তিনি আরও বলেন, “২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৪৮০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করতে অত্যাবশ্যক।”
নাকম-এর নির্বাহী পরিচালক এস.এম. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের অর্থনীতি ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর ১.৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করেছিল, ২০২২ সালের বন্যা ও ভূমিধসে ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে, এবং ২০২৪ সালের ঘূর্ণিঝড় রেমাল ৫৮৩.৪ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করেছে।”
নেপালের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. মাধব কার্কি বলেন, “জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং সমতা নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার এবং এলডিসি দেশগুলোর যৌথ দাবি অত্যন্ত জরুরি।”
বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থায়নের প্রধান আলোচক ড. ফজলে রাব্বি সাদেক বলেন, “জলবায়ু অর্থায়নের অনৈতিক এবং অন্যায্য হিসাব-নিকাশ ন্যায়বিচারের পথে বাধা। এলডিসি দেশগুলো কার্বন বাজেটের ১২% অংশ দাবি করার অধিকার রাখে।”
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফরহিনা আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ ও এলডিসি দেশগুলো কপ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের জন্য, নিছক আর্থিক সহায়তা প্রত্যাশার জন্য নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু শাসন কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত জলবায়ু ঋণ ঝুঁকি সূচক ২০২৪ ভবিষ্যতে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুসংহত করবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এর অতিরিক্ত সচিব, এ.কে.এম. সোহেল, উল্লেখ করেছেন, “কোপেনহেগেন চুক্তির অধীনে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরবরাহের ওইসিডি’র দাবির পরেও, মাত্র ১৫% তহবিল জলবায়ু নির্দিষ্ট ছিল, যা একটি বড় ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে কপ২৩-এ এম. জাকির হোসেন খান ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য জলবায়ু ঋণের ফাঁদের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন—যা বর্তমানে জলবায়ু ঋণ ঝুঁকি সূচক ২০২৪ (সিডিআরআই) দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে জলবায়ু ঋণ ২৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারনে এশিয়া এবং আফ্রিকার তিনটি দেশ সবচেয়ে বেশি ঋণের চাপে রয়েছে।
প্রতিবেদনটি আরও তুলে ধরেছে যে, জলবায়ু অর্থায়নের বড় একটি অংশ প্রশমন (মিটিগেশন) কার্যক্রমে কেন্দ্রীভূত, যেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোর জন্য অত্যাবশ্যক অভিযোজন প্রচেষ্টা উপেক্ষিত হয়েছে। এই বৈষম্য দূর করতে এবং এলডিসিগুলোর ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে কার্বন ট্যাক্স, সম্পদ কর এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি সংস্কারসহ শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর মিজান আর খান, রিসার্চ ফেলো, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি; প্রফেসর আব্দুর রব মোল্লাহ, চেয়ারম্যান, ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নাকম); পরমিতা অরনী, গবেষণা সহকারী, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ; এবং তানজির হোসেন, গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স অ্যাডভাইজার, অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনাল। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সালাউদ্দিন আহমেদ রেজা, সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টিভি।