অন্তবর্তী সরকারের একগুচ্ছ উদ্যোগের পরও পুঁজিবাজারে দরপতনের রহস্য কী
শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই নানা অনিয়মে জর্জরিত ছিল পুঁজিবাজার। কিন্তু অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অবশ্য চার কার্যদিবস সূচকের উত্থান হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী থাকেনি। এর ভেতরে থাকা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আবারও বাজার নিয়মিত পতনের বৃত্তে পড়ে যায়। এরই ধারাবাহিক পতনে গত ২৮ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এর পয়েন্ট নামে পাঁচ হাজারের নিচে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এরপর সরকারের আর কিছু সিদ্ধান্ত ও কারসাজির অভিযোগ এনে রাস্তায় নামেন বহু বিনিয়োগকারীরা। শুরু হয় আন্দোলন ও মানববন্ধন।
এরপর পুঁজিবাজার ইস্যুতে একের পর এক বৈঠক ও অন্তর্র্বতী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের পুঁজিবাজার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আশ্বাস বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখলেও দরপতন থামছে না। এছাড়া অন্তর্র্বতী সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনের নেয়া নানামুখী উদ্যোগের পরও পতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার।
ফলে বাজার একদিন বাড়লেও তিন দিন দরপতন ঘটছে। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন পার করছে। বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে গেছে, প্রায় প্রতিদিনই কমছে এর আকার। এরপর থেকে অল্প সংখ্যক কোম্পানির শেয়ারদরে ঊর্ধ্বগতির বিপরীতে অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে বহু কোম্পানির দর।
মুলত ২০১০ সালের মহাধসের ক্ষত প্রায় দেড় দশক ধরে বয়ে বলা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন তলানিতে।
এ থেকে উত্তরণের পথ কী এই প্রশ্নে বাজারের সঙ্গে জড়িতদের পরামর্শও সুনির্দিষ্ট নয়। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা মিছিল, বিক্ষোভে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করছেন, যা বাজারে আত্মবিশ্বাস ফেরানোর ক্ষেত্রে আরেক অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, যার অনেকগুলোই বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করেছে, যাকে দেখা হচ্ছে নতুন সংকট হিসেবে।
নাম প্রকাশ না করে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, হঠাৎ করে ২৭ কোম্পানিকে ‘জেড’ এ পাঠাল। দোষ তো কোম্পানির। বিনিয়োগকারীদের তো কোনো দোষ ছিল না। তাদের (বিএসইসি) সিদ্ধান্তে তো আমার অনেক শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। তার ভাষ্য, বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় এমন সিদ্ধান্ত নিলে বাজার তো পড়বেই। আগে বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ভাবতে হবে। এটা না করে অন্য যাই করুক পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরবে না।
আরেক বিনিয়োগকারী রঞ্জন দাস বলেন, ‘নতুন কমিশনের এই কয় মাসে কয়েকটা কোম্পানির শেয়ারের দাম তো অনেক বেড়েছে, কারণ কিন্তু কেউ জানে না। এগুলা নিয়ে অনেক গুঞ্জন আছে। বাজার নিয়ে যে টাস্কফোর্স গঠন হয়েছে, তারা কী করছে, সেটিও ‘স্পষ্ট নয়’, ভাষ্য তার।
এছাড়া বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা যে, এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অভাব, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই বিনিয়োগ করেন। দর যখন বাড়তে থাকে, তখন তারা শেয়ার কেনে, আবার দর যখন কমে তখন দেখা দেয় বিক্রির প্রবণতা। বিনিয়োগ শিক্ষার এই অভাবের পাশাপাশি আছে কারসাজি থেকে শুরু করে অন্য সংকট।
কিন্তু বছর যায়, সেই সমস্যার আর সমাধান হয় না। অপরদিকে অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এগোতে পারেনি কখনও। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী ছিল আরেক ধাক্কা। সেই ধাক্কা সামলে ওই বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে টানা এক বছর বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিল সুসময়।
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আরও অবনতি হয় পরিস্থিতির। ডলার সংকট, রিজার্ভ ক্ষয়, মূল্যস্ফীতির লাফ, কোম্পানির লোকসান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন, সুদহার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা, বিনিয়োগে মন্দা- সব মিলিয়ে এখন অর্থনীতির জন্যই কঠিন সময়, এই পরিস্থিতি পুঁজিবাজারের জন্য আরও চ্যালেঞ্জের।
এদিকে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর ও টাকার পরিমাণে লেনদেন। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ২৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৩২৮ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৮২ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৭৬ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৮৩ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৫০ টির, দর কমেছে ১৮৫ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৮ টির।ডিএসইতে ৫০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ৭০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৫৭৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ।
অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৫ পয়েন্টে। সিএসইতে ২১৪ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৬ টির দর বেড়েছে, কমেছে ১১১ টির এবং ২৭ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৫ কোটি ৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।