আর্থিক খাতের শীর্ষ তিন কোম্পানির লুটপাটের ফিরিস্তি, অদৃশ্য কারণে শাস্তি হয়নি
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আর্থিক খাতে ব্যাপক লুটপাটের কারণে কয়েকটি ব্যাংক এখন প্রায় দেউলিয়া। বিভিন্ন নীতি-সহায়তা দিয়েও ঠিক করা যাচ্ছে না। এর চেয়ে খারাপ অবস্থা দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। মালিকপক্ষ, কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লুট হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২১ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক ধস খতিয়ে দেখতে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
২০০২ সাল থেকে এসব প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়ও নিরূপণ করবে এই কমিটি। তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে এই কমিটির প্রধান করা হয়। তদন্ত শেষে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত যত অনিয়ম হয়েছে, তার কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এ কারণে আর্থিক খাতে অনিয়ম লুটপাট বেড়েই চলছে।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরের পর বছর ধরে দুই প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদনে সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৪৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়। সাবেক ডেপুটি গভর্নররা হলেন সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, মুরশিদ কুলি খান, আবু হেনা মো. রাজি হাসান ও মো. নজরুল হুদা।
এ ছাড়া সাবেক নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম কায়-খসরু, মো. নওশাদ আলী চৌধুরী, মো. মাহফুজুর রহমান, শেখ আবদুল্লাহ, জোয়ার্দার ইসরাইল হোসেন, মো. শাহ আলম, এ টি এম নাসির উদ্দিন, শেখ আবদুল্লাহ, এ এন এম আবুল কাশেম, সিরাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার নাম আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। পিপলস লিজিংয়ের তদন্তেও একই ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
পিপলস লিজিংয়ে ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগ পর্যন্ত সংঘটিত অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং পি কে হালদারের সহযোগী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীদের হাতে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যাদের দায়ী করা হয়েছে, তারা হলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ, পরিদর্শন বিভাগসহ তৎকালীন জিএম ও তার ওপরের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ও নিয়মশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর বিভিন্ন ধারায় স্পষ্ট বর্ণনা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়ে ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছয়টি সার্কুলার জারি করে, যা ছিল আইনের ১৮ ধারার পরিপন্থি। সার্কুলারগুলো হচ্ছে ১৯৯৭ সালের মে মাসে এফআইডি সার্কুলার ৩, ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে এফআইডি সার্কুলার ১, ২০০১ সালের জুন মাসে এফআইডি সার্কুলার ৭, একই বছরের অক্টোবর মাসে এফআইডি সার্কুলার ৪, ২০০২ সালের ডিসেম্বরে এফআইডি সার্কুলার ১১ এবং ২০০৩ সালের জুন মাসে জারি করা এফআইডি সার্কুলার ৩।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ বেআইনি উদারতাই পিপলস লিজিংয়ে নিয়ন্ত্রণহীন অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আসল শক্তি বলে মনে করে তদন্ত কমিটি। পিপলস লিজিং এসব সার্কুলার ব্যবহার করেই ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদের লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করে মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এবং লুটপাট করেছে। পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীরা ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের দায়িত্বে আসেন। এরপর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় নিজেদের লোকজন বসিয়ে পরবর্তী তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে লুট করেছে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের মূল্য ছিল ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে দায়দেনা ছিল ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫ বছরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে লুট হয়ে গেছে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের কারণ উদ্ঘাটন (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটির প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে
কেমন আছে পিপলস লিজিং: গত জুন শেষে পিপলস লিজিংয়ে খেলাপি ঋণের হার ৯৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি মোট ঋণ দিয়েছে ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। তাদের বর্তমান পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্ট নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাগীর হোসেনকে অপসারণ করতে গভর্নরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে এই এমডির বিভিন্ন অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের মাধ্যমে গঠিত বোর্ডের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিয়মিত অফিস করার কথা নয়, কিন্তু পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হাসান শাহেদ ফেরদৌস নিয়মিত অফিস করছেন। এমনকি তিনি কর্মকর্তাদের কাজেও হস্তক্ষেপ করছেন বলে একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও ঠিকমতো মানতে চান না এই বোর্ডের সদস্যরা। এতে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগকারীদের আমানত ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বলে জানান একাধিক কর্মকর্তা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পিপলস লিজিং আমরা অবসায়নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলাম। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে সেখানে বোর্ড গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এখন তাদের কোনো নির্দেশনা দিলেই আমাদের হাইকোর্ট দেখাচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হাসান শহীদ ফেরদৌস বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ৮০ কোটি টাকার মতো অর্থ উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছি। এসব অর্থ থেকে কোর্টের নির্দেশে যেসব গ্রাহকের মানবিক সমস্যা রয়েছে তাদের অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজে হস্তক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, সেটা তো করতেই হবে।
যার যে দায়িত্ব তাকে সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আগে যখন লুট হয়েছিল, সে সময় জবাবদিহি ছিল না। এ ছাড়া এ যাবৎকাল কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, সে বিষয়ে অডিট হচ্ছে বলে জানান চেয়ারম্যান। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সগির হোসেন খানকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কী হাল: এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাসেল শাহরিয়া ও পরিচালকচক্র প্রতিষ্ঠানটির সিংহভাগ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে ৯৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। মোট বিতরণ করেছে ১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতি ৫৫০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে। এতে চেয়ারম্যান করা হয়েছে সাবেক মেজর জেনারেল মো. আনোয়ারুল ইসলামকে। বাকি চার স্বতন্ত্র পরিচালক হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুল হাকিম, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম, জনতা ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. মোখলেসুর রহমান ও মোস্তফা কামাল আহমদ।
জানা গেছে, ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল নিটল-নিলয় গ্রুপের। সেই সময় পর্যন্ত এফএএসের প্রায় ৩৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল নিটল-নিলয় গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির হাতে। ২০১৭ সালে পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলে যায় পি কে হালদারের হাতে। এরপর থেকেই অর্থ লুটপাট চলে প্রতিষ্ঠানটিতে।
ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট স্টকস অ্যান্ড বন্ড লিমিটেড (এফএসবিএল)। ৩১টি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণ দেখিয়ে ৪৭০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। মূল টাকা ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের হলেও এফএসবিএলের মাধ্যমে ওই টাকা ৩১টি প্রতিষ্ঠানের নামে ছাড় করানো হয়। ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত কয়েক ধাপে এ অর্থ উত্তোলন করা হয়। ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের সত্যতা মিলেছে একনাবিন চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অডিট প্রতিবেদনে। এ অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে ফারইস্ট স্টকস অ্যান্ড বন্ড লিমিটেডের উদ্যোক্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খানের সম্পৃক্ততার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (এফএফআইএল) চেয়ারম্যান এম এ খালেক, সাবেক চেয়ারম্যান এম এ ওহাব, গ্রিনল্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড ট্রাক্টর কোম্পানি লিমিটেডের (গ্যাটকো) পরিচালক কে এম খালেদ ও উদ্যোক্তা পরিচালক আমিনুল হকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজশে এ অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে একনাবিন চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্টস।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেডের (বিআইএফসি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান এই প্রতিষ্ঠানের মোট শেয়ারের প্রায় ৬২ শতাংশ দখলে রেখেছেন। এ ছাড়া সানম্যান গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ৫৪ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ হিসেবে টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের সঙ্গে আবদুল মান্নান জড়িত। আর এ ঋণ বিতরণের সময় বিআইএফসির চেয়ারম্যান ছিলেন তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান।
সবশেষ হিসাবে, বিআইএফসির ঋণের মধ্যে আবদুল মান্নান-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে পাওনা প্রায় ৬২১ কোটি টাকা। এর পুরোটাই খেলাপি। সুদসহ হিসাব করলে আবদুল মান্নানের কাছেই আটকা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭৪৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৭ শতাংশ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতিও রয়েছে আড়াই কোটি টাকার বেশি।
অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন পথে বসেছে। আলোচিত পি কে হালদারের নেতৃত্বে টাকাগুলো লুট করা হয়। এর মূল চাবিকাঠি নাড়েন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের তখনকার ডিএমডি রাশেদুল হক, যিনি পরে প্রতিষ্ঠানটির এমডিও হন। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত ছিল এই চক্র। মূলত এই প্রতিষ্ঠানের ঋণের সিংহভাগেরই সুবিধাভোগী পি কে হালদার ও চট্টগ্রামভিত্তিক আলোচিত ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলম। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৩ দশমিক ৬০ শতাংশ।
চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আভিভা ফাইন্যান্সও এখন প্রায় মৃত্যুর পথে। প্রতিষ্ঠানটির আগের নাম ছিল রিলায়েন্স ফাইন্যান্স। পি কে হালদারের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান লুট করেছে। তার মধ্যে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ছিল অন্যতম। পরে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে আভিভা ফাইন্যান্স রাখা হয়। কিন্তু চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৪৪১ কোটি টাকা।
ঋণ অনিয়মসহ নানা কারণে ডুবতে বসেছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডিকে গত বছরের ডিসেম্বরে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এস এ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, আমান সিমেন্ট মিলস ইউনিট-২, মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ম্যাক স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং গ্রাহক নাজমা পারভিন, ফারহান মোশাররফের ঋণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন থাকার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি বর্তমানে ১৪ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। এজন্য হয়তো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দেওয়া কঠিন হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যেই একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ধীরে ধীরে সব প্রতিষ্ঠানে দিকে নজর দেওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। তারা নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসতে পারেনি। পুঁজিবাজারেও তাদের অবদান নেই। এজন্যই একটা বড় ব্যাংকের বড় শাখা দেশের অর্থনীতিতে যে ধরনের অবদান রাখছে, পুরো খাত মিলেও সেই অবদান রাখতে পারছে না এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের কার্যক্রম বিস্তারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজর দেওয়া দরকার।