আ’লীগকে ডুবিয়েছেন ওবায়দুল কাদের, কাদেরের ডাকে সাড়া দেননি শেখ হাসিনা!
আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। অসংখ্য নেতাকর্মী সরকার পতনের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আগেই গোপনে দেশ ছেড়ে যান। আত্মগোপনে চলে যান অসংখ্য নেতাকর্মী। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে ধরা পড়েছেন।
তবে সরকার পতনের আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট থেকে কোথাও দেখা মিলছে না আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে কেউ কেউ বলছিল দেশত্যাগ করেছেন আবার কেউ কেউ বলছিল তিনি দেশেই আছেন। তবে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানিয়েছে ওবায়দুল কাদের দেশ ছেড়েছেন। তিনি যশোর সীমান্ত হয়ে অবৈধভাবে ভারতে গেছেন।
ভারতে যাওয়ার পর তিনি স্ত্রীসহ একটি রিসোর্টে রয়েছেন। ওই রিসোর্টে ওবায়দুল কাদের চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ আনানো হয়েছে। তিনি প্রয়োজনে অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এর বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। তার অবস্থানের সঠিক ‘লোকেশন’ জানানো হচ্ছে না। কারণ কলকাতায় অবস্থানরত অনেক নেতা-কর্মী তার প্রতি ক্ষুব্ধ। এখানে তার সঠিক অবস্থান জানতে পারলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটতে পারে।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারে ও দলটির সবার কাছেই নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড এবং স্বৈরাচারী আচরণের এক উদাহরণ হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মুখে সবসময় নীতিবাক্য শুনালেও বাস্তবে নীতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের এক প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি। যদিও ভয়ে এতদিন মুখ খোলেননি কেউই।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং সড়ক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, ওপরে সততার খোলস পড়ে থাকলেও ওবায়দুল কাদেরের ভেতরটা সম্পূর্ণ উল্টো। অনেকের মতে, আওয়ামী লীগের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র সাধারণ সম্পাদক, ভাবমূর্তির মানদণ্ডে সবার কাছেই যার অবস্থান ছিল শূন্যের কোটায়। তবুও এ নেতাই হয়ে যান দলটির তিনবারের সাধারণ সম্পাদক।
যে কারণে দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে কাদেরের নেতৃত্বের আওয়ামী লীগকে। তার দায়িত্বে থাকা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে বড় বড় কাজে বড় দুর্নীতি-অনিয়মের খবর এখন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, মুখে সততার কথা বললেও কার্যত অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করতেন সাবেক এ মন্ত্রী। জোকার হিসেবেও পরিচিত সর্বমহলে।
তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, দলের তিন তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েক দফা চেষ্টা করেও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পাননি। কারণ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তার ওপরে প্রচণ্ড বিরক্ত। অনেকের মতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধও। এ কারণে তিনি সাক্ষাতের অনুমতি দেননি। অবশ্য ওবায়দুল কাদেরের ওপরে ক্ষুব্ধ দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীও। এ কারণে ভারতে অবস্থান করলেও নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ থেকে বাঁচতে তিনি আত্মগোপনে আছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ভারতে অবস্থান করলেও কৌশলগত কারণেই শেখ হাসিনার অবস্থান কাউকে জানানো হচ্ছে না। তবে ফোনে তিনি ঘনিষ্ঠ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। সেই সূত্র ধরেই শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন ওবায়দুল কাদের। তবে সফল হননি বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের একাধিক নেতা নিশ্চিত করেছেন। যদিও এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দলটির নেতারা।
তবে কেন্দ্রীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারত আমাদের নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) তাদের দেশের প্রটোকল অনুযায়ী যথাযথ সম্মান দিয়েছে। নেত্রী যদি কারও সঙ্গে দেখা করতে চান, সে ব্যবস্থাও রয়েছে। ইতোমধ্যে তার কন্যাসহ অনেকের সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে এখনো নেত্রীর দেখা হয়নি। এর বেশি কিছু ওই নেতা বলতে চাননি।
২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। এরপর আরও দুবারসহ প্রায় আট বছর ধরে একই পদে রয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত এই নেতা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে এখন এই নেতার অত্যন্ত নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীরাও তার প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ রয়েছেন।
সরকার পতনের পরপরই তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গোপনে ভারতে চলে যান। গত ১১ নভেম্বর থেকে স্ত্রীসহ কলকাতায় অবস্থান করলেও তা গোপনই রেখেছেন ওবায়দুল কাদের। কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও দলের সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাই তার সঠিক ‘লোকেশন’ সম্পর্কে অবগত নন বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, এটি জেনেই নেতা-কর্মীদের আক্রোশ কমানোর জন্য সময়ক্ষেপণ করছেন। সবার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন এই নেতা। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের সরকার পতনকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের কারণে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ওপর নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সময় বেফাঁস কথাবার্তা বলে তিনি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন বলে আলোচনা আছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি দল ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পেছনে কেউ কেউ তাকেও দায়ী করে থাকেন।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছিলেন নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ-কবিরহাট) আসনের সংসদ সদস্য। আর তার ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জা ছিলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র। দুই ভাই ওপরে ওপরে বিরোধ দেখালেও ভেতরে ভেতরে একে অপরের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য। ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের।
তখন ওই সরকারের যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার ওই ক্ষমতার জোরে ছোট ভাই কাদের মির্জা হয়ে ওঠেন এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক। ১৯৯৮ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে নেন বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যানের পদ। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য (বর্তমানে প্রয়াত) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ১ হাজার ৩৭১ ভোটে হারিয়ে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য’ নির্বাচিত হন। পরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পরিবর্তিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এক যুগের বেশি সময় একই পদে থেকে নিজের এবং পরিবারের আখের গুছিয়েছেন তিনি।
তার প্রভাবে মন্ত্রণালয়, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এ ছাড়া ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী, ভাই, ভাগিনাসহ তাদের আত্মীয়স্বজন এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। এমনকি তার ব্যক্তিগত কর্মচারীরাও আজ শতকোটি টাকার মালিক। ২০১৮ সালে টানা তৃতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কাদের মির্জা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
২০২০ সালের পর মিডিয়ায় বিভিন্ন কথা বলে আলোচনায় এসে ফেসবুক লাইভে ‘সবকিছু’ ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখাতেন ভাইকে। তবে ওপরে দুই ভাইয়ের বিরোধ দেখা গেলেও ভেতরে ভেতরে তারা গড়ে তোলেন চাঁদাবাজির মহাস্বর্গরাজ্য। ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এলাকার এমপিদের মনোনয়ন-বাণিজ্য, দলের জেলা-উপজেলা কমিটি-বাণিজ্য, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ থেকে টাকা আদায়, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকাজ থেকে ১০ পারসেন্ট হারে কমিশন, টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও বিভিন্ন মেগা প্রকল্প থেকে ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে টাকা হাতিয়ে নিতেন কাদের মির্জা।
অভিযোগ রয়েছে, স্কুল মাস্টারের ছেলে ওবায়দুল কাদের ও তার পরিবারের সদস্যদের একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরালেও দুই যুগের ব্যবধানে তারা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। চতুর ওবায়দুল দেশের চাইতে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে আবদুল কাদের মির্জা নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে-বেনামে দেশে ব্যাপক সম্পদ গড়েছেন। ওবায়দুল কাদেরের এপিএস বরিশালের আবদুল মতিন, পিএ নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মো. জাহাঙ্গীর কবিরও শতকোটি টাকার মালিক।
এমনকি তার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দেওয়া চাকর নুরুল করিম জুয়েলও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া ওবায়দুল কাদেরের ভাগিনা পরিচয় দিয়ে ইস্কান্দার মির্জা শামীম ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন দপ্তর থেকে হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অন্যদিকে আলী হায়দার রতন নামে কথিত এক ভাগিনাকে দিয়ে দেশের বড় বড় প্রকল্পের কাজ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে ভারত, সিঙ্গাপুর, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে টাকা পাচার করে সম্পদ গড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আইয়ুব আলী, চরহাজারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন সোহাগের বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এ এস এম মাঈন উদ্দিন পিন্টুর মাধ্যমে ওবায়দুল কাদের ও কাদের মির্জা হাজার হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। মাঈন উদ্দিন পিন্টু যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অ্যাংকর ট্রাভেলসের মালিক। অন্যদিকে চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর ভাই জিয়াউর রহমান নিউইয়র্কের বড় ব্যবসায়ী। আইয়ুব আলীও ৫ আগস্টের পর যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন।
বড় ভাই ওবায়দুল কাদের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়ার কারণে টানা সাড়ে ১৫ বছর দল ক্ষমতায় থাকাকালে ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার কাছে জিম্মি ছিলেন গোটা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মানুষ। ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারির পৌরসভা নির্বাচনে কাদের মির্জা টানা তৃতীয়বারের মতো বসুরহাট পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। তার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই দলেরই নেতা-কর্মীরা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরের মতো কাদের মির্জারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।