আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলো তারল্য সংকটে হাহাকার
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে অনিয়ম, লুটপাট ও নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। এর ফলে পুরো ব্যাংকিং খাত অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও (এনবিএফআই)। অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের চেয়েও বহুগুণ বেশি সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে এনবিএফআই।
বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি এখন এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে নতুন করে আমানতও রাখতে চাচ্ছেন না গ্রাহকরা।
ফলে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো অস্থিরতা কাটছে না। কয়েকটি ব্যাংকের তারল্যসংকট প্রকট হওয়ার খবরে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বরং আরও খারাপ হয়েছে। কিছু ব্যাংক যখন গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়, তখন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত সরিয়ে নেন অনেক গ্রাহক। এ কারণে ওই সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণ কমাতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের আমানত ও ঋণ উভয়ই কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আমানত ও ঋণের চিত্র পর্যালোচনায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুটা বেড়ে ৪৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকায় উঠেছিল। তবে চলতি বছরের মার্চে তা কিছুটা কমে হয় ৪৭ হাজার ৩০ কোটি টাকা। তবে জুনে আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এরপর গত সেপ্টেম্বরে আবার আমানত ৬৮ কোটি টাকা কমে ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। যা গত মার্চে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। গত জুনে ঋণ আরও বেড়ে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ওঠে। তবে সেপ্টেম্বরে ঋণ ৭৭৮ কোটি টাকা কমে ৭৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকায় নেমে আসে। অবশ্য গত পাঁচ বছর ধরেই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধুঁকছে। বিশেষ করে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার যখন চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গিয়েছিলেন তখন থেকেই সমস্যা প্রকট হতে থাকে।
প্রতিষ্ঠান চারটি হলো : পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও এফএএস ফাইন্যান্স। এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পিকে হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন। যা ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজম বলেন, অনেক ব্যাংক বড় সমস্যায় পড়েছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ভালো অবস্থায় নেই। কারণ অনেক ভালো বড় করপোরেট গ্রুপ আগাম ঘোষণা ছাড়াই টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। সে জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমে যাচ্ছে। গত জুন মাসের শেষে আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। সে হিসাবে ৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
দেশে ১৫টির বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে পি কে হালদার-সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হারই সর্বোচ্চ, ৯৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা, এফএএস ফিন্যান্স ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা এবং আভিভা ফিন্যান্স ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। এর বাইরে ফারইস্ট ফিন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ,
জিএসপি ফিন্যান্সের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ফার্স্ট ফিন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফিন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফিন্যান্সের ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, আইআইডিএফসির ৫৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, হজ ফিন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ফিনিক্স ফিন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ফিন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বে লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং উত্তরা ফিন্যান্সের ৫০ দশমিক ৪৮ শতাংশ।