সপ্তাহজুড়ে পুঁজিবাজারে ২৩ হাজার কোটি টাকার মূলধন উধাও, নেপথ্যে আস্থা সংকট
শহীদুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। আওয়ামী সরকারের পতনের পর সংশ্লিষ্টরা ভেবেছিলেন এবার ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীরাও হয়ে উঠেছিলেন আশাবাদী। অবশ্য সরকার পতনের পর কয়েকদিনের পুঁজিবাজারে সেই প্রতিচ্ছবিও পরিলক্ষিত হয়েছে। সেই সময়ে সূচকের উল্লম্ফনের সঙ্গে লেনদেনও ছাড়িয়েছিল ২ হাজার কোটি টাকা। তবে এর স্থায়িত্ব ছিল হাতেগোনা কয়েকদিন। এর পর টানা দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার।
কোনোভাবেই থামছে না সূচকের পয়েন্ট হারানো ও দরপতন। বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ আর ক্রন্দন। প্রতিদিনই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। ভিটেবাড়ি ও সম্পদ বিক্রি করে এখানে বিনিয়োগ করে আজ পথে বসেছে। আশার আকাশে প্রতিদিনই নিরাশার কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। লোকসান দিতে দিতে বিনিয়োগকারীরা আজ সর্বশান্ত হচ্ছেন। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যস্ত রয়েছেন জরিমানা ইস্যুতে।
একের পর এক কোম্পানিকে কারসাজির অভিযোগে জরিমানা করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছেন। ফলে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। বিনিয়োগকারীদের অভিমত এটা ২০১০ সালের বাজার পরিস্থিতির চেয়ে ভয়াবহ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা মধুর মধুর কথা বলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পরিবারকে সর্বশান্ত করছেন। এছাড়া দরপতন ঠেকাতে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেন না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
ফলে টানা দরপতনে পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদে মতিঝিলের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। ফলে মোটা দাগে মার্চেন্ট ব্যাংকের ফোর্সড সেল ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব এবং সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাকে এবং জরিমানা ইস্যুতে পুঁজিবাজারে টানা দরপতন হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে খাদের কিনারায় পুঁজিবাজার। লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটির ঘরে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরের কয়েক মাসে একগুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে সেগুলো আস্থা ফেরাতে পারছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসির নীতি পদক্ষেপগুলো হচ্ছে: বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে তহবিল জোগানে সহায়তা, জরিমানার মাধ্যমে বিএসইসির আদায় করা অর্থ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কাজে লাগাতে ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি ভালো ও লাভজনক কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে আইপিও আইন সংস্কার ও কর প্রণোদনার ব্যবস্থা করা,
পুঁজিবাজারে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে একদিন করা, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোয় থাকা অনাদায়ি পুঞ্জীভূত ঋণাত্মক ঋণগুলোর (নেগেটিভ ইক্যুইটি) চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, উচ্চ সম্পদশালীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে মূলধনি মুনাফার করহার কমানো, শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আর কখনো ফ্লোর প্রাইস আরোপ না করা, সুশাসন ও আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানান উদ্যোগের পরও পুঁজিবাজারে টানা পতন অব্যাহত। ফলে সপ্তাহজুড়ে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধনের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান কাজ হচ্ছে পুঁজিবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তারা বাজারকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে তারাই ভালো বলতে পাবে। বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিশ্চয়তা দেওয়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ। পুঁজির নিশ্চয়তা না পেলে এই বাজারে বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই ইতিবাচক বাজারের নিশ্চতয়তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে সপ্তাহজুড়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সব সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। আলোচ্য সপ্তাহজুড়ে সূচকের সঙ্গে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের মোট বাজার মূলধন কমেছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। ডিএসই ও সিএসইর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত সপ্তাহের শুরুতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৭০৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। সপ্তাহ শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫২ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন কমেছে ১১ হাজার ২০৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা বা ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। দেশের অপর পুঁজিবাজার সিএসইতে গত সপ্তাহের শুরুতে বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ২১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর সপ্তাহ শেষে বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৩৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকায়।
সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১১ হাজার ৮১৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মোট বাজার মূলধন কমেছে ২৩ হাজার ২৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। চলতি সপ্তাহে কমেছে ডিএসইর সবকটি সূচক। প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৯১ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এছাড়া, ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৩০ দশমিক ০২ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর ডিএসইএস সূচক কমেছে ২৩ দশমিক ৯২ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ০৬ শতাংশ। সূচকের পতনের পাশাপাশি ডিএসইতে কমেছে লেনদেনের পরিমাণও। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬১০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর আগের সপ্তাহে মোট লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ২২১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এক সপ্তাহে লেনদেন কমেছে ৬১০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। চলতি সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৩২২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৪৪৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে ৩৯২টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৭৬টি কোম্পানির, কমেছে ২৯৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৩টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। এদিকে, সপ্তাহ ব্যবধানে দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই ও সিএসসিএক্স যথাক্রমে ১ দশমিক ৯০ শতাংশ ও ১ দশমিক ৯১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৩০৪ পয়েন্টে ও ৮ হাজার ৭০২ পয়েন্টে।
এছাড়া, সিএসআই সূচক ১ দশমিক ৭০ শতাংশ ও সিএসই-৩০ সূচক ০ দশমিক ২০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯২৫ দশমিক ৩৮ পয়েন্টে ও ১১ হাজার ৭৫৫ দশমিক ৯৩ পয়েন্টে। আর সিএসই-৫০ সূচক কমেছে অবস্থান করছে ১০৮৩ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে।
ফলে সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, যা এর আগের সপ্তাহে ছিল ২৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সপ্তাহ ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ৫৬ লাখ টাকা। সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে ৩১৫টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৬৭টির, কমেছে ২১৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৫টি কোম্পানির শেয়ার দর।