আলমগীর হোসেন ও শহীদুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কঠিন চাপের মুখে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। দিন যতই যাচ্ছে লোকসানের মাত্রা ততই বাড়ছে। তবে অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা সহ বাজারের নীতি নির্ধারকরা আশার আলো দেখালেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ফলে বাজারের উপর আস্থা রাখতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় টানা দরপতনের কারণে সবাই বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নতুন বিনিয়োগ নেই। বিপরীতে শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি। এতে ক্রমাগত পতনে পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। এর মধ্যে আওয়ামীলীগ সরকারের গত ১৭ বছরেও বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিনিয়োগকারীদের আশা ছিলো বাজার এবার ঘুরে দাঁড়াবো। তেমনি সরকার পতনের পর গত পাঁচ কার্যদিবস সূচকের বড় উত্থান হলেও রাশেদ মাকসুদ কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত পাঁচ মাসে বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা রাশেদ মাকসুদ কমিশনের ওপর কী করে আস্থা রাখবেন।

এছাড়া দৈনিক লেনদেনের ধীর গতিতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। মুলত বিএসইসি চেয়ারম্যানের নেয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে তৈরি করেছে আস্থার সংকট। তেমনি বিএসইসি এখন পর্যন্ত এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যে সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরবে। এরই মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা বিএসইসি চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বললে গত দুই কার্যদিবস সূচকের বড় উত্থান হয়।

এর মধ্যে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকের দাবি থাকলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে পদ থেকে সরাতে চাই না। এমন বক্তব্যের পরও গত দুই কার্যদিবস সূচকের দরপতন হয়েছে। এখন প্রশ্ন বিএসইসি চেয়ারম্যান সরানোর খবরে সূচকের উত্থান হলেও না সরানোর খবরে সূচকের বড় দরপতন হয়েছে। এ অবস্থায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে রাশেদ মাকসুদ কমিশনের উপর আস্থা নেই।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারে মূল সমস্যা আস্থা সংকট। আস্থা সংকটের নেপথ্যে রয়েছে বিএসইসি চেয়ারম্যান। বিএসইসি চেয়ারম্যান সরে দাঁড়ালো বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরবে। কারণ বিএসইসি চেয়ারম্যানের গত পাঁচ মাসের কর্মকান্ডে বিনিয়োগকারীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন। তার হুটহাট সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

এদিকে সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর ও টাকার পরিমানে লেনদেন। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের নেপথ্যে রয়েছে পাঁচ কারণ। এসব কারণ অনুসন্ধান না করতে পারলে বাজার স্থিতিশীল করা খুবই কঠিন বলে মনে করেন বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা।

প্রথমত, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত কয়েকদিন ইতিবাচক হয় পুঁজিবাজার। তবে তা ধরে রাখা যায়নি। এ সময়ে বিএসইসিতে পরিবর্তন আসে। একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে পরের দিন আবার পরিবর্তন করা হয়। পরে বর্তমান কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা একেবারেই অনভিজ্ঞ। বাজারের ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা নেই। নতুন উদ্ভাবন তো দূরের কথা, অনেক পরিভাষাই তারা বোঝেন না। এছাড়া নতুন কমিশনের বেশকিছু সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত। স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদ গঠনে বেশকিছু সিদ্ধান্ত বাজারে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে। বিষয়টি বাজার সংশ্লিষ্টরা ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেন না। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। অর্থাৎ কমিশন অনেকটাই বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন।

দ্বিতীয়ত, বাজারে যেসব প্রতিষ্ঠান বেশি লেনদেন করে, এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট বন্ধ। তবে ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকা যৌক্তিক হলেও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট বন্ধ রাখলে বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, উল্টা টানা পতন অব্যাহত রয়েছে।

তৃতীয়ত, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে বাজার স্থিতিশীল না করে একের পর এক জরিমানা করে পুঁজিবাজারের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করছেন। ফলে বাজারের মেকাররা আস্থা নিয়ে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। তাছাড়া মুনাফার চেয়ে বেশি জরিমানা করলে বাজারে বিনিয়োগ করার সাহস দেখাবে কী ভাবে। এছাড়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত কয়েকটি গেম্বলার গ্রুপ অলিখিতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। পরিস্থিতি একটু খারাপ হলেই কমিশন থেকে বড় হাউজ এবং কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারীকে শেয়ার কিনে বাজার সাপোর্ট দিতে বলা হতো। বর্তমানে গ্রুপগুলো নিস্কিয়। ফলে বাজারে লেনদেন বাড়ছে না।

চতুর্থত, পুঁজিবাজারে সংকটের আরেকটি কারণ মার্জিন ঋণ শেয়ার (কেনায় ঋণ সুবিধা)। বর্তমানে মার্জিন ঋণের হার ১:০.৮। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারীর ১ লাখ টাকা থাকলে তাকে আরও ৮০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হবে। কিন্তু অনেক হাউজ এই সীমা মানেনি। ফলে বাজার কিছুটা নেতিবাচক হলেই শেয়ার বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করা হয়। এতে পতন আরও ত্বরান্বিত হয়।

পঞ্চমত, রাশেদ মাকসুদ কমিশন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে তৈরি করেছে আস্থার সংকট। অন্যদিকে কোন বিনিয়োগকারী বেশী পরিমাণ শেয়ার কিনলেই বিএসইসি থেকে ফোন দিয়ে কারণ জানতে চাওয়া হয়। বিনিয়োগকারীদের কাছে কারণ জানতে চাইলে ভয়ে কী শেয়ার কিনবে। এছাড়া ডিএসই সার্ভিলেন্সের বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে। পাশাপাশি ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এছাড়া বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট আস্থার ঘাটতি রয়েছে ।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক কমিশন ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার কারণে প্রায় দুই বছর এই মার্কেটে ঠিকভাবে ট্রেডিং হয়নি। এই ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার আগে মার্কেট ওভার ভ্যালুড ছিল এবং আর্টিফিসিয়ালি শেয়ারের প্রাইস বাড়ানো হয়েছিল। যখন কারেকশন শুরু হলো, তখন বিএসইসির সাবেক শিবলী কমিশন এই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিলো, যা ২০ মাস ধরে আরোপিত ছিল।

দীর্ঘ এই সময়ে অধিকাংশ শেয়ারে ট্রেডিং না হওয়ার কারণে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেইসঙ্গে চলমান রাজনৈতিক ও নানাবিধ অনিশ্চয়তায় বর্তমানে আস্থার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। পরিণতিতে বাজার ওভার কারেকশন হচ্ছে এবং বাজারে নেগেটিভ রিটার্ন তৈরি হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদহার ১২ শতাংশ। কিন্তু পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ১২ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। গত ১০ থেকে ১৫ বছরে আমাদের মূল্যস্ফীতির তুলনায় পুঁজিবাজার নেগেটিভ রিটার্ন দিয়েছে। বাজারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিনিয়োগ নাই বললেই চলে।

এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। দীর্ঘদিন থেকে এই সংকট চলে আসছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় রাজনীতিসহ সবকিছু যোগ হয়েছে। ফলে সবার আগে আস্থা সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

জানা গেছে, দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ১৮৫ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক .৫৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৫৮ পয়েন্টে এবং ডিএসই–৩০ সূচক ১ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯২১ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৯৬ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১১৮ টির, দর কমেছে ২১৪ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৬৪ টির। ডিএসইতে ৩০৭ কোটি ১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ১২০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৪২৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৮০ পয়েন্টে। সিএসইতে ১৮৩ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৯ টির দর বেড়েছে, কমেছে ৭৭ টির এবং ২৭ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৪ কোটি ১১ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।