Libra-Infusion20160212083334

ফয়সাল মেহেদী : ভুল বা গড়মিল হিসাব ও অনিয়মের মধ্য দিয়েই অর্থবছর সম্পন্ন করেছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেড। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের প্রান্তিক প্রতিবেদনে গড়মিল হিসাব প্রকাশ ও ঘোষণা ছাড়াই বোর্ড সভা করে এ কোম্পানি। এদিকে কোম্পানির বিরুদ্ধে হিসাবে কারচুপি করার অভিযোগ ওঠলেও তা সংশোধন করা হয়নি। এর আগের অর্থবছরেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে হিসাবে কারসাজি করার অভিযোগ উঠে ছিল।

জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি ১.০৪ টাকা লোকসান হলেও কারসাজি করে আয় দেখিয়েছে ০.৭৮ টাকা। আর প্রথম নয় মাসে ৩.০৬ টাকা শেয়ারপ্রতি আয় হলেও দেখানো হয়েছে ৪.৮৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে হিসাবে কারসাজি করে শেয়ারপ্রতি আয় ১.৮২ টাকা করে বাড়িয়ে দেখিয়েছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস নিয়ে বারবার কারসাজি করলেও এ অনিয়মের দায়ে দৃশ্যমান কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি লিবরা ইনফিউশনস বা এর পরিচালনা পর্ষদকে। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ বিষয়ে জানতে কোম্পানির সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করেও কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডিএসই’র ওয়েবসাইটে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসের অর্থাৎ অর্ধবার্ষিকের (জুলাই-ডিসেম্বর’ ১৬) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে কোম্পানিটি ছয় মাসের মোট শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস দেখিয়েছে ০.৭৮ টাকা। তবে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বা প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর’ ১৬) এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৫.৭৮ টাকা। আর পরবর্তী তিন মাসে বা দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর’ ১৬) শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস দেখায় ৪.৭৪ টাকা। সে হিসেবে এই দুই প্রান্তিক মিলে অর্ধবার্ষিকে এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হওয়ার কথা ১.০৪ টাকা। অথচ কোম্পানিটি অর্ধবার্ষিকে শেয়ারপ্রতি আয় দেখিয়েছে ০.৭৮ টাকা। অর্থাৎ এক টাকার বেশি লোকসান হলেও আয় দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা করছে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ।

এদিকে ২৭ এপ্রিল সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের সর্বশেষ প্রকাশিত তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ’ ১৭) এ কোম্পানি শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস দেখিয়েছে ৪.১০ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২.৯৫ টাকা। আর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিক মিলে (জুলাই’ ১৬-মার্চ’ ১৭) মোট নয় মাসে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ৩.০৬ টাকা হলেও দেখানো হয়েছে ৪.৮৮ টাকা। অর্থাৎ হিসাবে কারচুপি করে নয় মাসে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ১.৮২ টাকা বেশি দেখিয়েছে কোম্পানিটি। এ গড়মিল তথ্য ডিএসইরও নজরে এসেছে। ফলে কোম্পানির প্রোফাইলে অর্ধবার্ষিক ও নয় মাসের হিসাবে ‘লাল চিহ্ন’ দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসই’র এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের ভুল তথ্য দেওয়া কোম্পানিগুলো ডএসই’র নজরে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে কোম্পানির তথ্যে কোনো গড়মিল থাকলে তা লাল কালিতে চিহ্নিত করা হয়। আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গড়মিল বা ইচ্ছাকৃত কারসাজির কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে’। তিনি আরও বলেন, কোনো কোম্পানির হিসাবে অসঙ্গতি থাকলে তা সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর সংশোধন করা হিসাব ডিএসইতে জমা দিলে প্রোফাইলে যুক্ত করা হয়। তবে নির্দেশ দেওয়ার পরেও যারা হিসাব সংশোধন করেনি তাদের প্রোফাইল হালনাগাদ হয়নি।

এর আগের অর্থবছরেও (২০১৫-১৬) লিবরা ইনফিউশনসের বিরুদ্ধে মুনাফা ও ইপিএস কারসাজির অভিযোগ উঠেছিল। ওই অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর’ ১৫) এ কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস দেখানো হয়েছিল ৮.১৪ টাকা। অথচ আলোচ্য হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর’ ১৫) শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৭.৬৬ টাকা। ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধ না করে মুনাফা হিসেবে দেখানোর কারণে ওই অর্থবছরের অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে লিবরার মুনাফা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। আর ওই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৯ কার্যদিবসে কোম্পানির শেয়ারদর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে ডিএসই লিবরার আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ওই সময় একটি প্রতিবেদন তৈরি করে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী কারসাজি করে মুনাফা বেশি দেখানো হয়েছে মনে করে দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক হিসাব সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

ঘোষণা ছাড়াই বোর্ড সভা : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে তাদের হিসাব বছরের প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে চাইলে তিন দিন পূর্বে পর্ষদ (বোর্ড) সভার ঘোষণা দিতে হয়। আর ওই ঘোষণা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে এবং সময়ে সভা করতে হয় পরিচালনা পর্ষদকে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুলেশন- ২০১৫ এর ধারা ১৬ এর উপ-ধারা ১-এ বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির আর্থিক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করণ এবং অন্তরবর্তী কালীন ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত বোর্ড সভার জন্য নির্ধারিত তারিখের তিন দিন পূর্বে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং কমিশনকে জানাতে হবে, যা ২০১৫ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করা হয়। জাতীয় পত্রিকায় মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে প্রকাশ করারও বাধ্য-বাধকতা রয়েছে। অথচ লিস্টিং রেগুলেশনের কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের ও অর্ধবার্ষিকের পর্ষদ সভা (বোর্ড মিটিং) সম্পন্ন করে ডিএসই’র মাধ্যমে ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেড।

এ কোম্পানির নিজস্ব ওয়েবসাইটেও বোর্ড সভা সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। কবে-কখন পর্ষদ (বোর্ড) সভা করেছে তারও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হওয়ার সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশীদ চৌধুরি বলেন, ‘লিবরার বিরুদ্ধে মুনাফা ও ইপিএস কারসাজির অভিযোগ আগেও এসেছে। বিএসইসি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি। তাই আবারো একই ধরনের অন্যায় করার সাহস পেয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিলে বারবার কারসাজি করার সাহস পেত না’। এসব অনিয়মে বলির পাঠা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান তিনি।