tometo_picরাজশাহী: কয়েক দিন টানা অবরোধের মধ্যে চলতি দরের অর্ধেকেও বিক্রির জন্য ক্রেতা মেলেনি। ফলে মাঠের টমেটো পচেছে মাঠেই।

গোদাগাড়ীর বিজয়নগর এলাকার কৃষক মোহাম্মদ সুমন আলী এবার প্রায় ২৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে চাষ করেছেন শীতকালীন টমেটো।

প্রতি বিঘা জমিতে টমেটো চাষে তাঁর গড়ে খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকা করে। সেই হিসাবে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে তাঁর। কিন্তু টমেটো বিক্রি করে এখন পর্যন্ত পেয়েছেন তিন লাখ টাকার মতো।

জমিতে এখনো যে টমেটো আছে বর্তমান বাজার মূল্যে তার দাম সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। ফলে ২৫ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করে সুমনকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো লোকসান গুনতে হবে।

শুধু সুমনই নন, হরতাল-অবরোধের ফাঁদে পড়ে এবার গোদাগাড়ীর প্রায় ৮৫ শতাংশ টমেটোচাষিকেই একই হারে লোকসান গুনতে হবে। এবার টমেটো চাষ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেক কৃষক।

কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, গতবার এই সময়ে পাকা টমেটো বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে। গতকাল রবিবার সেখানে একই টমেটো বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে। আগের কয়েক দিন বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। গতবার প্রতি মণ কাঁচা টমেটো বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা মণ দরে।

গতকাল বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে। আগের কয়েক দিন টানা অবরোধের মধ্যে চলতি দরের অর্ধেকেও বিক্রির জন্য ক্রেতা মেলেনি। ফলে মাঠের টমেটো পচেছে মাঠেই। এখন অনেক কৃষক খরচ উঠছে না বলে মাঠ থেকে টমেটো তুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

কোনো কোনো এলাকায় শ্রমিকরাই মাঠ থেকে টমেটো তুলে নিয়ে এসে বাজার বা মোড়ের অস্থায়ী আড়তে বিক্রি করে নিজেরাই টাকা রেখে দিচ্ছে।উত্তরাঞ্চলের টমেটো এলাকা হিসেবে পরিচিত গোদাগাড়ীর বিজয়নগর, লালবাগ, কলেজ মোড়, উজানপাড়া, রেলগেট বাইপাস, কাদিপুর, সাহাব্দিপুর, কুমুরপুর, মহিষালবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠজুড়ে থোকায় থোকায় ধরে আছে সবুজ টমেটো।

কোনো কোনো জমির পাশেই পচা-আধাপচা টমেটো পড়ে আছে। কোথাও কোথাও হাঁস-মুরগি ও গরুর দলকে টমেটো খেতে দেখা যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও জমি থেকে তুলে আনা টমেটো বাড়ির পাশের ওঠানে জমা করে পাকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।উপজেলার বিভিন্ন মোড়ে বা স্কুলের পাশেই মাঠে বসা অস্থায়ী আড়তগুলোতে চলছে টমেটো বেচাকেনা। কোনো কোনো মাঠ থেকে শ্রমিকরা টমেটো তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। দেখে মনে হবে এ যেন টমেটোরই এলাকা। আসলেই তাই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বরেন্দ্র এলাকা এই গোদাগাড়ীর প্রায় নব্বই শতাংশ কৃষকই টমেটো চাষ করে থাকেন। আর এর আয় দিয়েই চলে তাঁদের সংসারের বেশির ভাগ খরচ। সুখ-দুঃখও তাই এই টমেটোকে ঘিরেই নেমে আসে কৃষকদের ঘরে ঘরে। যেবার দামের সঙ্গে ফলনও বেশি হয়, সেবার এ উপজেলার কৃষকদের ঘরে থাকে আনন্দের বন্যা।

আবার যেবার ফলন বা দাম কম হয় সেবার নেমে আসে অশান্তি। এবার ফলন ভালো হলেও অব্যাহত অবরোধ ও হরতালের কারণে টমেটো চাষ করে প্রায় ৮৫ শতাংশ কৃষককেই মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এতে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ধারদেনা করে সেই টাকা এখন আর পরিশোধ করতে পারছেন না। ঋণের জালে আটকা পড়ছেন তাঁরা।
কুমুরপুর এলাকার কৃষক আবদুল মমিন জানান, এবার তিনি প্রায় চার বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। প্রায় ১৫ দিন ধরে তাঁর জমি থেকে টমেটো তোলার উপযোগী হয়ে আছে। কিন্তু প্রথম এক-দুই চালান টমেটো তোলার পর তিনি আর জমির দিকে যাননি। ফলে জমির টমেটো পচছে জমিতেই।
কৃষক মমিন বলেন, ‘প্রথমবার চার বিঘা জমি থেকে প্রায় ২৫ মণ টমেটো বিক্রি করে দাম পাওয়া গেছে এক হাজার ৯০০ টাকা। আর সেই টমেটো জমি থেকে সংগ্রহ করতে শ্রমিকের পেছনে খরচ হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা। পরিবহন খরচ দিতে হয়েছে আরো ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকা।

সেই সঙ্গে গোটা একটা দিনের পরিশ্রম। দিন শেষে নিজের পকেটে ঢুকেছে মাত্র ৫০০ টাকা। এরপর থেকে আর জমিতে যাইনি। জমির টমেটো পচছে জমিতেই।’গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় তিন হাজার ৩৩৩ হেক্টর জমিতে শীতকালীন হাইব্রিড জাতের টমেটোর চাষ হয়েছে।

আবহাওয়া ভালো থাকায় টমেটোর ফলনও ভালো হয়েছে। ফলে এবার অন্তত প্রায় ১৫ লাখ টন টমেটো উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু দাম না থাকায় কৃষকরা ব্যাপক হারে লোকসান গুনছেন।
গোদাগাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ড. সাইফুল আলম জানান, গোদাগাড়ীর প্রায় তিন হাজার কৃষক টমেটো চাষ করেছেন। কিন্তু ৮৫ শতাংশ কৃষকই টমেটোর দাম না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে আগামী বছর তাঁরা টমেটো চাষে আগ্রহ হারাতে পারেন।