যে কারণে মন্ত্রী হতে পারলেন না!
মান্না আতোয়ার, ঢাকা: আলোচিত-সমালোচিত ও প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন। আর বাদ পড়েছে বলে এতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ দক্ষতা বা দুর্নীতির কারণে তাদের মন্ত্রীত্ব হারিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। যাদের অনেকেই বিগত মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় এবং দলে দাপুটে নেতা হিসেবেই খ্যাত ছিলেন।
নতুন মন্ত্রিসভায় বাদ পড়াদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত পাঁচ বছরে নানা অনিয়ম-অভিযোগসহ বিভিন্ন কারণে নতুন মন্ত্রীসভায় জায়গা হয়নি। জানা গেছে এদের মধ্য অনেক মন্ত্রী ও মন্ত্রীপত্নীর অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া, অতি কথনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, অদক্ষতা, মন্ত্রী হওয়ার পরে তৃণমূল নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে ঢাকায় বসে এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেন, গত সরকারে যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে এই মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।তাই বর্তমান সময় হচ্ছে সংকটকালীন সময়, এই মুহূর্তে কি পেলাম আর কি পেলাম না সেটা নিয়ে না ভেবে সহযোগীতা করা উচিত বলে মনে করি।
বিতর্কিতরা এই মন্ত্রিসভায় নেই জানিয়ে আ’লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের পর সবারই দৃষ্টি ছিল মন্ত্রিসভা কেমন হবে। আমার মনে হয় মোটামুটি ক্লিন মন্ত্রিসভা হয়েছে। বিতর্কিতরা নেই বললেই চলে।
রবিবার তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আ’লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এর সঙ্গে শপথ নেন ২৯ জন মন্ত্রী, ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও এবং ২ জন উপমন্ত্রী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হয়েছে। তবে এবারই প্রথম সংসদীয় রীতি ভেঙ্গে প্রধান বিরোধী দল (জাতীয় পার্টি-জাপা) থেকে বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো।
মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইসিটি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ।
আরও বাদ পড়েছে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান খান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান, পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. মজিবুর রহমান ফকির, শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই।
শুধু মন্ত্রিসভা থেকেই বাদ পড়েননি, দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, আইসিটি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়া।
গত মহাজোট সরকারের প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামীদের গ্রেফতারের আল্টিমেটাম ও ঈদের ছুটিতে বাড়িতে তালা দেওয়ার কথা বলে সমালোচনা ঝড় তুলেন। এর পর মন্ত্রিসভার রদবদলে স্বরাষ্ট্রের পরিবর্তে দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগের। তৃতীয়বারের আ’লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি তাকে।
ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বির্তকিত কর্মকান্ডের কারণে সরকারকে বিব্রত অবস্থানে ফেলে। সাভারের রানা প্লাজার ভবন ধসে পড়ার পর ‘ধাক্কা’ তত্ত্ব তিনি বলেছিলেন। সাবেক এই জাদরেল আমলা দক্ষতার সঙ্গেই নিজের দায়িত্ব পালন করবেন এই প্রত্যাশাই ছিল সরকারের উর্ধ্বতন মহলের।
কিন্তু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের বিচার নিয়ে বার বার আল্টিমেটাম, সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্যামেরার সামনেই সাগর-রুনি সম্পর্কে কিছু বক্তব্যের মাধ্যমে শুধু নিজেকেই নয়, হাস্য-কৌতুকের পাত্রে পরিণত করেছেন সরকার এবং দলকেও।
প্রশাসনবেষ্টিত রাজনীতি, আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুরত্ব, নরসিংদীর জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকা-সহ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে। মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার অভিযোগ ও মামলায় মন্ত্রীর ভাই সালাউদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু, পিএস মুরাদসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার নাম উঠে আসে।
আ’লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ছিলেন মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি গত পাঁচ বছরে বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও সমুদ্রসীমা জয় ছাড়া বাংলাদেশের জয় শূন্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্ম্পকের টানাপোড়ন বলে আ’লীগের নেতাকর্মীরাই মনে করেন। অভিযোগ, ড. ইউনুসের সঙ্গে সর্ম্পকের অবনতিও তার কারণে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে এপিএস ছাত্রদল নেতা খোকনও কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট বাড়ি। ডা. আ ফ ম রুহুল হকের কারণেই সাতক্ষীরা মূলত জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে জেলা আ’লীগের সাংগঠনিক কোনো কর্মকান্ডেও ভূমিকা ছিল না তার।
গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ফ্লাট ও প্লট বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম করেছেন। তাছাড়া নামে-বেনামে সরকারি বাড়ি কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ছেলের ভোট ডাকাতি, নিজের বাঁচালতা,সর্বশেষ কাদের মোল্লার ফাসির সময় বলে দেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে শামসুল হক টুকুর বিরুদ্ধে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার ও তার ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। ভাতিজা ও তার এপিএস সাজ্জাদ হোসেন সাগর টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে রংপুরে পুলিশের হাতে আটক হন।
তার ছেলে সোহাগ বাংলালিংক কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করতো। এখন সে শত কোটি টাকার মালিক। পুরো জেলার টেন্ডার, নিয়োগ, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতো মাহমুদুল হাসান সোহাগ। আর চাচাতো ভাই আলমগীর হোসেন রন্টু জেলার ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। মোতাহারের বিরুদ্ধে অনিয়মের রিপোর্ট করতে গিয়ে হাতিবান্ধার সাংবাদিক সায়েম সাবুরের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে রয়েছে তার এপিএসের রেলের অর্থ কেলেঙ্কারীর অভিযোগ। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের কন্যার কোম্পানির কাছে সরকারি অর্থ পাওয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হয়।
ক্লিন ইমেজের ড. আব্দুর রাজ্জাকও খাদ্যে নিয়োগে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তবে দলের এক প্রভাবশালী নেত্রীর বিরোধিতার কারণেই তার কপাল পুড়ছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। ড. হাছান মাহমুদের স্ত্রীর নামে ব্যবসা-বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া ফারুক খান, ক্যাপ্টেন তাজসহ কয়েকজন নেতা ক্ষমতার পালাবদলে স্বাভাবিক নিয়মেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। তবে ফারুক খান সপ্তাহে একদিন বাজার না করার কথা বলে সমালোচিত হয়েছিলেন। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার দক্ষতার অভাবেই মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন বলে অভিযোগ।
শিল্পখাতে সাফল্য না আসার ব্যর্থতা দিলীপ বড়ুয়ার। তার নিজ ও পরিবারের সদস্যের নামেও বেশ কয়েকটি প্লট নিয়ে বির্তক রয়েছে। পার্বত্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার এবার দলীয় মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, পানি সম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে দক্ষতার অভাবেই মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে বলে অভিযোগ।
স্বার্থের কারণে এবার দলের মনোনয়ন নেননি পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ারভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীরউত্তম। এছাড়া মহাজোট সরকারের জাতীয় পার্টির একমাত্র মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের সংসদ সদস্য না হওয়ায় এবার মন্ত্রিত্ব পাননি।