চট্রগ্রাম ব্যুরো: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি গোল্ডেন সন লিমিটেড বিরুদ্ধে এবার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করলেও বন্ডের শর্ত অনুযায়ী পণ্য রফতানি করেনি গোল্ডেন সন লিমিটেড।

আমদানিকৃত কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণও পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। শর্ত অনুযায়ী ১২টি ইউপির (ইউটিলাইজেশন পারমিশন) বিপরীতে ৩ লাখ ৭২ হাজার কেজি কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার করে পণ্য তাইওয়ানে রফতানি কারার কথা।

তবে এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি ২ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

বন্ড কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, মেসার্স গোল্ডেন সন লিমিটেড শতভাগ রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে নিবন্ধিত; যার বন্ড লাইসেন্স নম্বর{৫(১৩) কাস: বন্ড : কমি :/ আকা:/ বন্ড (সাধা:)/০৮/২০০৫}। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য উৎপাদনের জন্য বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে।

এসব কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে— এমএস শিট, ক্যাবল ওয়্যার, অ্যালুমিনিয়াম ইনগট, রোটর, কপার ওয়্যার, ক্যাপাসিটার, রোটর উইথ বোশ, এসএস শিট, রোটর রবার ওয়াশার, এমএস রড, প্লাগ টার্মিনাল, টিপিএমসি। আমদানি শর্ত অনুযায়ী শুল্কমুক্ত এসব কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য রফতানি করার কথা। কিন্তু উৎপাদিত পণ্য রফতানি না করে অবৈধভাবে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ প্রসঙ্গে গোল্ডেন সন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহমেদ বলেন, ‘শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেয়ার মতো কোনো অনিয়মের সঙ্গে আমরা জড়িত নই। এটা নিছক একটা ভুল বোঝাবুঝি। ১২টি ইউপির বিপরীতে যেসব পণ্য শর্ত অনুযায়ী রফতানি না করার অভিযোগ আনা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা শিগগিরই বন্ড কমিশনারেটকে যথার্থ যুক্তি উপস্থাপন করব।’

পণ্য আমদানিতে গোল্ডেন সন লিমিটেডের লিয়েন ব্যাংক হিসেবে কাজ করে এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির সরবরাহ করা দলিলাদি পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায়, মেসার্স গোল্ডেন সন লিমিটেড ইউপি (নম্বর : ৯৬২৬/২০১১; তাং ৩১-০৭-২০১১)-এর বিপরীতে পণ্য উৎপাদনের জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার ৬১৬ কেজি টিপিএমসি (থার্মোপ্লাস্টিক মোল্ডিং কম্পাউন্ড) ব্যবহারের অনুমোদন নেয়।

৮ শতাংশ হারে অপচয় বাদ দিয়ে ইউপিতে উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃত ওজন দেখানো হয় ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৬৬ কেজি। কিন্তু পণ্যের ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট এবং শিপিং এজেন্টের বিএল অনুযায়ী, তাইওয়ানে রফতানি করা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৫০০ কেজি মোবাইল টেবিল সেট। এক্ষেত্রে ২২ হাজার ৮৬৬ কেজি পণ্য রফতানি না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিয়ে ৭ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৬ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে গোল্ডেন সন।

একই প্রক্রিয়ায় ইউপি (নম্বর: ১১৮০৭/২০১১, তাং ২৫-০৯-২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৬ কেজি পণ্য রফতানি না করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয় ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৪৪ টাকা, ইউপি (নম্বর: ১৪৭৬২/২০১১, তাং ০৭-১১-২০১১)-এর বিপরীতে ৪১ হাজার ৭৪৮ কেজি রফতানি না করে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৩ টাকা, ইউপি (নম্বর : ১২১০৬/২০১১, তাং ২৯-০৯-২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৭ কেজি রফতানি না করে ১১ লাখ ৪২ হাজার ৫২৪ টাকা, ইউপি (নম্বর : ১২১০৭/২০১১, তাং ২৯/০৯/২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৬ কেজি রফতানি না করে ১১ লাখ ২৩ হাজার ১৫৯ টাকা,

ইউপি (নম্বর : ১০৭১৫/২০১১, তাং ২৮-০৪-২০১১)-এর বিপরীতে ২২ হাজার ৮৬৬ কেজি রফতানি না করে ৭ লাখ ৪০ হাজার ৫৯৫ টাকা, ইউপি (নম্বর : ১২৮০৩/২০১১, তাং ১৬-১০-২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৬ কেজি রফতানি না করে ৯ লাখ ২৭ হাজার ৮৬৯ টাকা, ইউপি (নম্বর : ১৩১৪৪-২০১১, তাং ২৩-১০-২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৬ কেজি রফতানি না করে ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৭৬৮ টাকা,

ইউপি (নম্বর : ১৩১৪৩/২০১১, তাং ২৩-১০-২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৬ কেজি রফতানি না করে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩২৩ টাকা, ইউপি (নম্বর : ১২৮০৩/২০১১, তাং ১৬-১০-২০১১)-এর বিপরীতে ২৭ হাজার ৩৬৬ কেজি রফতানি না করে ৯ লাখ ২৭ হাজার ৮৬৯ টাকা, ইউপি (নম্বর :

৯৬২৭/২০১১, তাং ৩১-০৭-১১)-এর বিপরীতে ৫৫ হাজার ৮৭৩ কেজি রফতানি না করে ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৮৩৫ টাকা এবং ইউপি (নম্বর : ১০৭১৬/২০১১, তাং ২৪-০৮-১১)-এর বিপরীতে ৩৬ হাজার ৬৭৭ কেজি পণ্য তাইওয়ানে রফতানি না করে অবৈধভাবে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিয়ে ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকার রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট।

কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, বন্ডের শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল  কোনো প্রতিষ্ঠান কেবল রফতানিজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু গোল্ডেন সন লিমিটেড এ সুবিধায় শর্তসাপেক্ষে কাঁচামাল আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে প্রায় ২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।

এক্ষেত্রে কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬৯-এর সেকশন ১৩(৩) অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স বাতিলের বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে তার আগে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার আবদুল মান্নান শিকদার বলেন, তদন্তে গোল্ডেন সন লিমিটেডের রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে।  পণ্যের ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট ও শিপিং এজেন্টের বিএল প্রভৃতি দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ইউপিতে অতিরিক্ত কাঁচামাল ব্যবহার দেখিয়ে অনুমোদন গ্রহণ করে। কিন্তু এসব কাঁচামাল উৎপাদনে ব্যবহার না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এ ব্যাপারে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।

এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে সম্প্রতি জানা গেছে, শতভাগ খেলনা পণ্য রফতানি করবে গোল্ডেন সনের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি জিএসএল এক্সপোর্ট লিমিটেড। এজন্য কোম্পানিটি জার্মানির শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী স্টেফেন ক্রিসটেনশনের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সম্পন্ন করেছে।

কোম্পানির পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে, সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী জিএসএল এক্সপোর্ট লিমিটেডের মূলধনের ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ করবেন স্টিফেন ক্রিসটেনশন, ৪০ শতাংশ গোল্ডেন সন এবং বাকি ১০ শতাংশ অর্থ বেলাল আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করবেন।