family-texফয়সাল মেহেদী : দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লিস্টিং রেগুলেশন ফের ভঙ্গ করেছে ফ্যামিলিটেক্স বিডি লিমিটেড। প্রান্তিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অনুমোদন সংক্রান্ত পর্ষদ বা বোর্ড সভার না করেই ব্যবসায়ের খতিয়ান প্রকাশ করেছে বস্ত্র খাতের এ কোম্পানি, যা ডিএসই’র লিস্টিং রেগুলেশন- ২০১৫ এর ধারা ১৬ এর উপ-ধারা ১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এর আগেও একই আইন একাধিক বার ভেঙ্গেছে ফ্যামিলিটেক্সের পরিচালনা পর্ষদ। এদিকে লিস্টিং রেগুলেশন লঙ্ঘন ছাড়াও আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে। তবে বারবার আইন ভাঙ্গলেও কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্টক এক্সচেঞ্জ বা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

প্রতিবেদন প্রকাশ সংক্রান্ত বোর্ড সভার আয়োজন সম্পর্কে ডিএসই’র লিস্টিং রেগুলেশন- ২০১৫ এর ধারা ১৬ এর উপ-ধারা ১-এ বলা আছে, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির আর্থিক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণ এবং অন্তর্বর্তীকালীন ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত বোর্ডসভার জন্য নির্ধারিত তারিখের তিন দিন পূর্বে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং কমিশনকে জানাতে হবে।

অর্থাৎ বোর্ড সভার নির্ধারিত তারিখের তিন দিন আগেই বোর্ড সভার ঘোষণা দিতে হয়। কিন্তু ফ্যামিলিটেক্স চলতি হিসাব বছরের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বোর্ড সভা না করেই। এছাড়া নির্ধারিত সময়ে প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করেও একাধিকবার আইন লঙ্ঘন করেছে এ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ।

তথ্য মতে, এ কোম্পানি ডিএসই’র মাধ্যমে ১২ ফেব্রুয়ারি চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ করে। একই দিন দ্বিতীয় প্রান্তিকসহ অর্ধবার্ষিকের প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়। তবে প্রতিবেদন প্রকাশ সংক্রান্ত বোর্ড সভা কবে, কখন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনো তথ্যই ডিএসই’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি।

সর্বশেষ বোর্ড সভার ঘোষণা না দিয়েই তৃতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্যামিলিটেক্স কর্তৃপক্ষ। ২১ মে তৃতীয় প্রান্তিক ও মোট নয় মাসের প্রতিবেদন ডিএসই’র মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। দেখা গেছে, অর্ধবার্ষিক ও মোট ৯ মাসের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে তাও ত্রুটিপূর্ণ। জানা গেছে, সঠিক সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যবসার খতিয়ান প্রকাশ করার বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা বারবার লঙ্ঘন করছে ফ্যামিলিটেক্স কর্তৃপক্ষ।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লিস্টিং রেগুলেশন অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত জীবন বীমা কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য কোম্পানিকে তাদের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রান্তিক শেষ হওয়ার ৪৫ দিন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন ও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হবে।

আর জীবন বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন ৯০ দিন এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন ও উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হবে। তবে ফ্যামিলিটেক্স কর্তৃপক্ষ চলমান হিসাব বছরের সমাপ্ত সবগুলো প্রান্তিক প্রতিবেদনই প্রকাশ করেছে নির্ধারিত সময় লঙ্ঘন করে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থ হলে শাস্তি হিসাবে ডিএসই’র লিস্টিং রেগুলেশন- ২০১৫ এর ধারা ১৭ এর উপ-ধারা ৪-এ বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থতায় শাস্তি হিসাবে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা গুণতে হবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে।

যা ২০১৫ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশ করা হয়। অবশ্য আবেদনের প্রেক্ষিতে বিশেষ ক্ষেত্রে সময় বাড়াতে পারে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে এ কোম্পানি প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সময় বাড়ানোর কোনো আবেদন করেছিল কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ।

আলোচ্য বিষয়ে জানতে কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া টেলিফোন নাম্বারে ফোন দেয়া হলে প্রাত্যাশিত কোনো উত্তর মেলেনি। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, শীর্ষ কর্মকর্তারা কখন অফিসে আসেন কখন যান তার নিশ্চয়তা নেই। এদিকে কোম্পানি সচিবের ইমেইলে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ঋণ পরিশোধের জন্য ২০১৩ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ফ্যামিলিটেক্স বিডি লিমিটেড। ওই বছর সর্বোচ্চ মুনাফায় ছিল বস্ত্র খাতের এ কোম্পানি। তবে পরের বছর থেকেই মুনাফা ও শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ধারাবাহিকভাবে কমছে। এর জেরে দীর্ঘদিন ধরে ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের নিচে লেনদেন হচ্ছে কোম্পানিটির শেয়ারদর।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। পারিবারিক দ্বন্দ, সঠিক সময়ে আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেয়া, ধারাবাহিক মুনাফায় ধস, অতিরিক্ত স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে বেশি দরে তা বিক্রি করে দেয়াসহ ইতোমধ্যে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

যদিও একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৩ জুন কমিশনের উপপরিচালক শামসুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে এছাড়া সংস্থাটির পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য আর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে এ কোম্পানির অনিয়ম ক্রমশ বাড়ছে, যার বলির পাঠা হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বছর অর্থাৎ ২০১৩ সমাপ্ত অর্থবছরে সর্বোচ্চ মুনাফায় ছিল ফ্যামিলিটেক্স। আলোচ্য বছর শেষে এ কোম্পানির কর পরবর্তী মুনাফা ছিল ৯২ কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৭.২৬ টাকা। যা কোম্পানির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফা ও ইপিএস।

পরবর্তী বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে সর্বশেষ সমাপ্ত অর্থবছরে (৩০ জুন’ ১৬) অর্থাৎ ১৮ মাসে এ কোম্পানি মুনাফা করে ২৫ কোটি ২২ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং ইপিএস হয় ০.৮২ টাকা। সে হিসাবে তিন বছরের ব্যবধানে এ কোম্পানির মুনাফা প্রায় ৭৩ শতাংশ বা ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা কমেছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের সর্বশেষ প্রকাশিত তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ’ ১৭) ফ্যামিলিটেক্স লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখিয়েছে শুন্য। আর তৃতীয় প্রান্তিক শেষে মোট ৯ মাসে (জুলাই’ ১৬-মার্চ’ ১৭) ইপিএস দেখিয়েছে মাত্র ১ পয়সা। এর আগে প্রথম ছয় মাসে বা অর্ধবার্ষিকে (জুলাই-ডিসেম্বর’ ১৬) ফ্যামিলিটেক্স লিমিটেড শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল মাত্র ১ পয়সা এবং প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর’ ১৬) কোম্পানিটি ইপিএস ছিল শূন্য।

তথ্য মতে, তালিকাভুক্ত হওয়ার পর প্রথম সমাপ্ত অর্থবছরেই ১০০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে আলোচনায় আসে এ কোম্পানি। অবশ্য পরবর্তী সমাপ্ত অর্থবছরে ১০ শতাংশ এবং সর্বশেষ সমাপ্ত অর্থবছরে ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। সাধারণত ক্যাশ না দিয়ে স্টক ডিভিডেন্ড দিলে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি পায় এবং মুনাফা বাড়ারও সম্ভাবনা থাকে। অথচ এ কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলেও মুনাফা তো বাড়েইনি বরং কমছে।

এ কোম্পানি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর রশীদ চৌধুরী বলেন, ফ্যামিলিটেক্স নানামুখী অনিয়মে জর্জরিত। নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনই প্রকাশ করেনি। এমনকি বোর্ড সভার ঘোষণা না দিয়েই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সেচ্ছাচারিতায় কোম্পানিটি দেউলিয়া হতে বসেছে। বারবার আইন লঙ্ঘন করলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা আজ পর্যন্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে কঠিন কোনো শাস্তি দিতে পারেনি। এ কারণে দিন দিন অনিয়ম বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব অনিয়মের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা উচিৎ।

বিএসইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, যদি কোনো কোম্পানি বিএসইসির নির্দেশনা অমান্য করে তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোম্পানিগুলো কমিশনের নজরদারিতে রয়েছে।

উল্লেখ্য, কমিশনের ৪৬৫তম কমিশন সভায় ফ্যামিলিটেক্স কোম্পানিকে ১০ টাকা দরে ৩ কোটি ৪০ লাখ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৩৪ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। সংগ্রহ করা অর্থ ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় করার কথা ছিল। কোম্পানির ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিল বাঙ্কো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট।