দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অনেক চেষ্টার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পুঁজিবাজার। বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকুল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিন্মমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন। বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।

এ পরিস্থিতিতে বাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ সহ (আইসিবি) সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পোর্টফলিও ম্যানেজারসহ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বর্তমানে সাইডলাইনে থেকে বাজার পর্যবেক্ষণে বেশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া, বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী। এছাড়া রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত অনেকে মার্জিন লোন নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পরিণতিতে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে চরম ধস নেমেছে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের চেয়েও এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এ বিপর্যয়ের যত কারণ তা উঠে এসেছে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে। দেশ প্রতিক্ষণের পক্ষে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির যে কারণগুলো এসেছে তার মধ্যে রয়েছে: একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও, কোম্পানিগুলোর অযৌক্তিকভাবে কম ডিভিডেন্ড, তারল্য সংকট, দেশের সার্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক ধারা, পুঁজিবাজার সিন্ডিকেট এবং চরম অব্যবস্থাপনা। গত কয়েক মাসের বাজার চিত্রে ফুটে উঠেছে বিপর্যয়ের করুণ চিত্র।

চলতি বছরে ফেব্রুয়ারী থেকেই বাজার পরিস্থিতি অবনতির দিকে যেতে শুরু করে। প্রায় প্রতিদিন বাজার নামতে নামতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে মার্চের পর। গত ১৪ মার্চ ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ তা ৩ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ সময়ে ডিএসইর বাজার মূলধন প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে। একই সময়ে ডিএসইর মূল্যসূচক ৫ হাজার ৬৫৫ পয়েন্ট থেকে কমে ৫ হাজার ৩২১ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

ডিএসইর সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে গড়ে ৫ শতাংশেরও বেশি। সর্বশেষ বিদায়ী সপ্তাহে চার কার্যদিবসে ডিএসইতে ১ হাজার ২৩২ কোটি ৬২ লাখ ৪ হাজার ৪৭১ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের সপ্তাহ থেকে ৪৪০ কোটি ৮৭ লাখ ২১ হাজার ২৮৪ টাকা বা ২৬.৩৪ শতাংশ কম। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬৭৩ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার ৭৫৫ টাকা।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলেই বাজারের এ বিপর্যয় রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, গত কয়েক বছরে যেসব কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে তার বেশিরভাগই দুর্বল আর্থিক ভিত্তির। এসব কোম্পানি বাজারে আসার পর কোম্পানির পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছেন। অনেক কোম্পানি এখন বন্ধ রয়েছে।

দুর্বল ভিত্তির এই কোম্পানিগুলোকে বাছ-বিচার ছাড়াই ফেসভ্যালুর কয়েকগুণ বেশি প্রিমিয়ামসহ তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে বাজারে চাহিদার তুলনায় শেয়ার সরবরাহ বেশি হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বছর শেষে ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। অথবা ৫ থেকে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করছে। নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে বিনিয়োগকারীদের এক প্রকার ঠকানো হচ্ছে।

চাহিদার তুলনায় শেয়ার সরবরাহ বেশি থাকায় এবং অব্যাহতভাবে দরপতন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি থাকায় বাজারে তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি থাকা, বিনিয়োগ পরিস্থিতির অবনতি, কর আহরণে ঘাটতির কারণেও শেয়ারবাজারে নতুন কেউ বিনিয়োগ নিয়ে আসছে না।

এ ছাড়া নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠী মিলে একটি কারসাজির সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। এদের নিয়ন্ত্রণেই শেয়ারের দর ওঠানামা করে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট।

এ বিষয় জানতে চাইলে বাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানির কাগজপত্র তৈরি করে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়। শেয়ার বিক্রি করে উদ্যোক্তারা চলে যান। তিনি বলেন, বাজারে যেসব কোম্পানির প্রাথমিক শেয়ার আসছে সেগুলো খুবই ছোট মূলধনী।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এ বছর তালিকাভুক্ত হওয়া সব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে কারসাজির সুযোগ আছে। যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বড় কোম্পানি বিশেষ করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান, টেলিকম খাত বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে আনতে পারছে না। বাজেটে যদি কিছু কর সুবিধা দিয়ে এসব কোম্পানি আনা যেত তাহলে হয়তো পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াত। বাজেটে মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট সুবিধা দেওয়া হলেও অনেকের আস্থা আসত।

ডিবিএ সভাপতি ও ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বাজারে অযোগ্য কিছু কোম্পানি তালিকাভুক্ত করে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি এমন সব কোম্পানি আসছে শেয়ারবাজারে যেগুলোর ট্রেড শুরু হলে শেয়ার দর ফেসভ্যালুর নিচে নেমে যায়। বাজারে এসব কোম্পানিরই দৌরাত্ম্য চলছে।

বর্তমানে ২০ থেকে ৩০টি কোম্পানির শেয়ারদরই ফেসভ্যালুর নিচে। কোম্পানিগুলো বাজারে এসে কোনো ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয় না। বোনাস ডিভিডেন্ড দেয়। এটা এক ধরনের প্রতারণার শামিল। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো চালায় তারা নিজেদের মুনাফা চিন্তা করে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো স্বার্থ রক্ষা করছে না। এখন ভালো কোম্পানি না আনতে পারলে বাজার পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াবে না।

ডিএসইর সাবেক পরিচালক ও মডার্ন সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই নাহরিন বলেন, শেয়ার বাজারে যারা বিনিয়োগ করছেন তারা এখন পথে বসছেন। আমরা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করে লোকসান গুনছি। আর প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রিকারী টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসানো হচ্ছে। পুঁজিবাজার পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, চূড়ান্ত দুঃসময় চলছে পুঁজিবাজারে। বাজারের বাইরে আরেকটি বাজার তৈরি হয়েছে। গত চার-পাঁচ বছরে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর অভিহিত মূল্যের নিচে। কোম্পানির স্পন্সর শেয়ারহোল্ডাররা ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করছেন। ব্যাংক সুদ অনেক বেশি। এসব কারণে বাজারে এর বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মৌলিক বাজার এখন নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে বিএসইসিতে আমরা কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি। বুক বিল্ডিং পদ্ধতি সংস্কার এবং আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দিয়েছি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে আশা করি আস্থা ফিরে আসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, নিন্মমানের আইপিও বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। কিছু কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের সক্ষমতা, অর্থ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব প্রতিষ্ঠান জাঙ্ক শেয়ারে পরিণত হয়েছে। বাজার বিপর্যয়ের বড় কারণ কয়েক বছর ধরে তারল্য সংকট বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে টাকা সরবরাহ করছে। ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি নিন্মগতি। ফলে তাদের ঋণ প্রবাহ কমেছে। সক্ষমতা কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব মুদ্রাবাজারে পড়ছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম ভীতি কাজ করছে। আস্থাহীনতা এমন পর্যায়ে গেছে যে, আরও বেশি লোকসান এড়াতে শেয়ার বিক্রির পর বিনিয়োগকারীরা নতুন করে শেয়ার কিনছেন না। ফলে তারল্য সংকট মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ জন্য আইসিবিসহ ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। তাতে তারল্য সংকট কমবে।