দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আগামীতে পাঁচ কোটি টাকা বা তার বেশি খেলাপি ঋণ ক্রয় বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে। যদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয় তবে সেই খেলাপি ঋণ সরকারি বা বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির (এএমসি) কাছে বিক্রি করে দিতে পারবে। তবে এই এএমসি গঠনের জন্য এর আগে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

প্রণীতব্য এই আইন খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত বিদ্যমান অন্যান্য আইনের ওপরে অবস্থান করবে এবং এই আইনের অধীনে কোনো আদেশ অন্য কোনো দেওয়ানি আদালত বারিত বা স্থগিত করতে পারবে না বলেও সুপারিশে বলা হয়েছে।

এএমসি গঠনে সুপারিশ প্রদানের জন্য গত মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিই এএমসি গঠনের বিষয়ে ৯ দফা সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সুপারিশটি পর্যালোচনার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকেও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, সুপারিশে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায় বা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রণীতব্য আইনের অধীনে খেলাপি ঋণ কার্যকরভাবে আদায়ের জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি) গঠন করা যেতে পারে।

এএমসি সরকারি বা বেসরকারি উভয় ধরনেরই হতে পারে। প্রাথমিকভাবে এই এএমসির কার্যপরিধি তিন ধরনের হতে পারে। যেমন এক. স্থায়ী সম্পত্তি দ্বারা জামানতকৃত খেলাপি ঋণ আদায় বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। দুই. পাঁচ কোটি বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ খেলাপি ঋণ ক্রয় বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। তিন. ব্যাংকের সাথে এএমসির দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় চুক্তি।

সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, প্রণীতব্য আইনের অধীনে এএমসি গঠনের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে অথারাইজড অফিসার নিয়োগ করে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। অথারাইজড অফিসারকে জামানতকৃত সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে অর্থ আদায় অথবা সম্পদ ব্যবস্থাপনা করার ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে।

এই আইনের অধীনে ব্যাংকের নিযুক্ত অথারাইজড অফিসার এএমসি জামানতকৃত সম্পদের দখল গ্রহণ, বিক্রি অথবা হস্তান্তর কাজে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সরাসরি সহায়তা গ্রহণ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশে এএমসি সম্পর্কে আরো বলা হয়, প্রণীতব্য আইনের অধীনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের সমন্বয়ে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেবল এ ট্রাইব্যুনালে (জেলা জজ পর্যায়ে) প্রতিকার চাইতে পারবে বলে বিধান সংযুক্ত করা যেতে পারে।

প্রণীতব্য আইনের অধীনে কৃতকার্যের জন্য অন্য কোনো দেওয়ানি আদালতের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা বারিত বা রহিত করার বিধান সংযুক্ত করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এই আইনের বিষয়গুলো প্রচলিত অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য থাকার বিধানও রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি ঋণ খেলাপি প্রতিরোধে ব্যাংকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একটি মডেল গাইডলাইন প্রণয়ন করার জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে।

এর আগে গত ১৪ মার্চ এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের সাথে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ ধরনের কোম্পানি গঠনের কথা প্রথম বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বেসরকারিভাবে পরিচালনা করা হবে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা খেলাপি ঋণ আদায় করে যাবো। যেগুলো স্বাভাবিকভাবে আদায় করা যাবে না, সেগুলো আদায় করার জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হবে। এ কোম্পানি কোনো শক্তি খাটিয়ে নয়, নিয়ম-কানুনের মধ্যে থেকেই ঋণ আদায় করবে। ঋণ খেলাপিদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

এরপরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কোম্পানি গঠনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। তিন সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির আহবায়ক করা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মু. শুকুর আলীকে। অপর দুই সদস্য হলেন একই বিভাগের উপসচিব সাঈদ কুতুব এবং অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান।

কমিটির কার্যপত্রে পাঁচটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রয়োজনীয়তা, গঠনপ্রক্রিয়া, সম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা (যদি থাকে) এবং এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের রীতিনীতি পর্যালোচনা করা। কমিটিকে সুপারিশসহ ৩১ মার্চের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিংখাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অবলোপকৃত ঋণ ধরলে তা পরিমাণে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।