দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংক খাতে প্রতি বছরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এতে বড়ে চলেছে ব্যাংকের পুঞ্জীভূত মন্দ ঋণের পরিমাণ। আর ব্যাংকের আয় দিয়ে এই মন্দঋণের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোকে উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে বড় অঙ্কের প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হচ্ছে। উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। প্রভিশন ঘাটতি এসব ব্যাংকের মূলধন কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

স¤প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের কার্যরত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৫টি ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের দেশীয় ১১টি ও চারটি সরকারি খাতের।

এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। যে ১৫টি ব্যংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি, তারমধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে ৯টি ব্যাংক। সেগুলো হলো: সরকারি খাতের রূপালী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ঢাকা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক আমানতকারীদের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত মূলধন রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। একই কারণে খেলাপি ঋণের বিপরীতেও পর্যাপ্ত মূলধন (প্রভিশন) রাখতে হয়।

প্রভিশন সংরক্ষণের নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের ধরন (নিন্ম সন্দেহজনক ও মন্দ বা আদায় অযোগ্য) ২০ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়, অর্থাৎ কোনো খেলাপি ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত হলে তার বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে মুনাফা থেকে শতভাগ অর্থ প্রভিশন হিসেবে কেটে রাখতে হবে। প্রভিশন সংরক্ষণ করলে ওই ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে প্রভিশন ঘাটতিতে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। সর্বশেষ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে তিন হাজার ৩৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকার। রাষ্ট্রায়ত্ত অপর ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের তিন হাজার ৮৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৮৩৪ কোটি ও অগ্রণী ব্যাংকের রয়েছে ৫৯৩ কোটি টাকা। এছাড়া বেসরকারি খাতের মধ্যে ঢাকা ব্যাংকের ৩০৯ কোটি টাকা,

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২২৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯৫ কোটি টাকা। ট্রাস্ট ব্যাংকের ২৭০ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২২০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৯০ কোটি, এবি ব্যাংকের ১১২ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৭ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৮৫ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৩৪ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ২৩ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক খেলাপি ঋণের উচ্চ হারের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারেনি। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে চলতি বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র (নির্বাহী পরিচালক) মো. সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রভিশন ঘাটতি হলে ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও সব সময় অর্থ পায় না সরকারের পক্ষ থেকে। অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ের কোনো বিকল্প নেই প্রভিশন ঘাটতি কমানোর। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের ব্যাংকগুলোর তথ্য আসলে বোঝা যাবে কতটুকু উন্নতি হয়েছে।’

জানা গেছে, মূলত আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ায় এসব ব্যাংকের ঋণের বড় একটি অংশই এখন খেলাপি হয়েছে। আগ্রাসী ঋণের তুলনায় সংগ্রহ করতে পারেনি প্রয়োজনীয় আমানত। খেলাপি ঋণের উচ্চ হারের কারণে কমে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা। ব্যাংকগুলো কম সুদে আমানত নিয়ে বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করে। ঋণ আদায় না হলেও শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদে-আসলে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে হয়।

বিতরণকৃত ঋণ আদায় না হলেও নতুন আমানতের অর্থ থেকে মেয়াদপূর্তির আমানত পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভোগে। ফলে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারে না এসব ব্যাংক। এ বিষয়ে ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো নড়বড়ে হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে জাতীয় বাজেট থেকে প্রণোদনা দিয়ে মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি খাতের ব্যাংকের বেলায় সে সুযোগ নেই।

গত ডিসেম্বর শেষে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ছয় হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল শেষে প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৯টিতে ও টাকার অঙ্ক ছিল ৯ হাজার ৩৭৫ কোটি। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ দুুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ২০১৭ সাল শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৬১৪ কোটি টাকায়।