আবু আহমেদ: আমাদের নীতিনির্ধারকরা অনেকটা ভুলভাবে মনে করেন শেয়ারবাজার চাঙা হচ্ছে, যখন তারা দেখেন মূল্যসূচক উপরে যাচ্ছে এবং মনে করেন এই বাজার খারাপ যাচ্ছে, যখন শেয়ারের মূল্যপতন ঘটতে থাকে। তারা অনেকটাই শেয়ারবাজারের ভালো-মন্দকে মূল্যের ওঠানামার সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলেছেন।

একশ্রেণীর বিনিয়োগকারীও তা-ই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা ডে-ট্রেডারস (Day traders) তারাই এমনটি মনে করেন। তবে যেসব বিনিয়োগকারী দীর্ঘমেয়াদের জন্য বিনিয়োগ করেন, তারা শেয়ারের মূল্যের ওঠানামা নিয়ে তেমন উল্লসিত বা চিন্তিত কোনোটাই হন না। তারা দেখেন সময়ের ব্যবধানে তাদের শেয়ারগুলো বেশি মুনাফা দিচ্ছে কিনা।

শেয়ার থেকে দু’ধরনের মুনাফা আসে। এক. সময়ের ব্যবধানে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পেয়ে বিনিয়োগকারীর মূলধনী মুনাফা (Capital gains) অর্জিত হয়, অবশ্য বর্ধিত মূল্যে বিনিয়োগকারী যদি তার ধারণকৃত শেয়ার বিক্রি করেন। অন্য মুনাফা আসে লভ্যাংশ (Dividend) থেকে। বিনিয়োগকারীরা দেখেন বছর শেষে কোম্পানি তাদের কত ডিভিডেন্ড দিল।

এ ডিভিডেন্ড অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য বেশ ভালো আকর্ষণের বিষয়, যদি কোম্পানি ভালো ডিভিডেন্ড দেয়। কোনো কোনো কোম্পানি বছরে একাধিকবারও ডিভিডেন্ড দেয়। ডিভিডেন্ড আবার দু’ধরনের। এক. ক্যাশ ডিভিডেন্ড, দুই. স্টক বা বিনামূল্যে অতিরিক্ত শেয়ার প্রদান।

কোম্পানি তাদের প্রয়োগকৃত মূলধনের আকার বাড়াতে গেলে স্টক ডিভিডেন্ড দেয়। অন্য বিষয় হল, কোম্পানি শেয়ারপ্রতি বছরে যে আয় করে, যাকে বলা হয় ইপিএস (earnings per share), তা পূর্ণাঙ্গভাবে বা ইপিএসের সবটাই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করে না।

আয়ের একটা অংশ কোম্পানির সঞ্চিতির (reserve) হিসাবে রেখে দেয়া হয়। আয়ের যে অংশ রেখে দেয়া হয় তাকে বা অবশিষ্ট অংশকে আর্থিক বিজ্ঞানের ভাষায় রিটেইন্ড আর্নিং বলা হয়। কোম্পানি রিটেইন্ড আর্নিং রেখে দেয় চলতি অর্থের জোগান দেয়ার জন্য, বা জমায়িত রিটেইন্ড আর্নিং থেকে কোম্পানি ইচ্ছা করলে ব্যবসা বৃদ্ধির জন্যও ব্যয় করতে পারে।

সত্য হল, কোম্পানির ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিটেইন্ড আর্নিং বা নিজস্ব তহবিল থেকে। তবে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী চান কোম্পানি তাদের বেশিরভাগ আয় বা পূর্ণ আয় ডিভিডেন্ড হিসেবে বণ্টন করে দিক। এজন্যই যেসব কোম্পানির ডিভিডেন্ড পে-আউট ভালো সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাজারে বেশি।

আমাদের অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ভালো হলেও বা সেগুলোতে প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেলেও শেয়ারবাজারের অবস্থা তেমন ভালো নয়। একসময় এ বাজারের আকার ছিল জিডিপি’র ২২ শতাংশ। আজ সেটি নেমে ১৬ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে। এর দুটো ব্যাখা হতে পারে।

এক. শেয়ারের গড় মূল্য কমে গেছে, যেটা অবশ্য সত্য; আর অন্য ব্যাখ্যা হল, জিডিপি শেয়ারের মূল্যের থেকে বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত একটা বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে সব শেয়ারের মূল্য market expertisation করে stocks জিডিপি প্রবৃদ্ধির থেকে বেশি হারে বাড়ে। বাংলাদেশে হয়েছে উল্টো।

গত ৬-৭ বছরে অনেক বিনিয়োগকারীই শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বাজার ত্যাগ করেছেন। এখন যারা বাজারের সঙ্গে আছেন তাদের ৯০ শতাংশই ডে-ট্রেডারস। এরা অনেক সময় জুয়ায় অংশগ্রহণের মতো নিজেদের ভাগ্যকে পরীক্ষা করতে কোনো শেয়ার বেচাকেনা করেন। কয়েকদিনের ব্যবধানে লাভ করলে ভালো, না করলে লোকসানে বিক্রি করে ওই শেয়ার থেকে বের হয়ে আসেন।

কেন শেয়ারবাজারটি জুয়াতাড়িত? এর প্রধান কারণ হল বাজারটি ছোট। অন্যদিকে ২-৩ বছরের জন্য বিনিয়োগ করার মতো ভালো শেয়ারের সংখ্যা খুবই কম। ফলে যারা আছেন তারা ডে-ট্রেডিংয়ের মধ্যে নিত্যদিন লাভ খোঁজেন। এরা খুশি হন শেয়ারের মূল্যসূচক যখন একটানা বেশ কয়েকদিন বাড়তে থাকে।

এরা হতাশ হন শেয়ারের মূল্য যখন কমতে কমতে তলানির দিকে যায়। একটা ভালো শেয়ারবাজারের বৈশিষ্ট্য হল, ওই বাজারে দীর্ঘমেয়াদের জন্য বিনিয়োগযোগ্য অনেক শেয়ার থাকবে। এবং বাজারের গভীরতা এমন হবে যে, কেউ এককভাবে বা একত্রে মিলে সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্য বাড়াতে-কমাতে পারবে না। ভালো বাজারের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল, যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে সেগুলোর হিসাবে তথা আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা থাকা।

অন্য কথায়, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে জবাবদিহি করবে। অর্থাৎ Good governance বা সুশাসন বলতে যা বোঝায় তা নিশ্চিত করা।

অনেকগুলো রেগুলেটরি মানতে বাধ্য করানোর মাধ্যমে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে সুশাসন কিছুটা উন্নতি হয়েছে বটে; তবে তা আন্তর্জাতিক মানের অনেক নিচে। ফলে অনেক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর বিনিয়োগকারীদের প্রচণ্ড অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।

অন্য সত্য হল, শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তেমন উপকার পাননি। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী সময়ের ব্যবধানে তাদের মূলধন হারিয়েছেন। তবে যারা আইপিও ইস্যু করেছে তারা দারুণভাবে এ বাজারকে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছে।

অনেক কোম্পানি বছরের পর বছর তাদের ক্ষুদ্র শেয়ার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে গেছে। অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা প্রিমিয়াম মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে কয়েক বছরের মাথায় উৎপাদন ও অফিস বন্ধ করে দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, অনেক শেয়ার বিনিয়োগকারী সময় থাকতে তা ধারণাও করতে পারেননি। তারা হয়তো শেয়ার কিনেছিলেন ৩০ টাকায়, এখন তার মূল্য দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ টাকা!

প্রতারক উদ্যোক্তার অভাব নেই আমাদের শেয়ারবাজারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনেক নন-পারফরমিং কোম্পানিকে হয় “y” ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দিয়েছে নতুবা শাস্তিস্বরূপ OTC মার্কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু সত্য হল, এতে কোম্পানির উদ্যোক্তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি হয়েছে ওইসব শেয়ার বিনিয়োগকারীর, যারা বিশ্বাস করে একসময় তাদের শেয়ার উচ্চমূল্যে কিনেছিলেন। অনেক বিনিয়োগকারীই শেয়ারবাজারে এসে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। যারা নিঃস্ব হয়েছেন তাদের অনেকেই প্রতারণার শিকার।

শেয়ারবাজারকে ভালো ও বিশ্বাসযোগ্য করার ক্ষেত্রে সরকার মনে হয় আন্তরিক। তবে যেটা আমরা দেখি সেটা হল এ ক্ষেত্রে সরকার যেন বারবার ভুল করছে। বাজেট প্রস্তাবের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা দেয়া যেতে পারত।

প্রণোদনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল ভালো কোম্পানির শেয়ারকে বাজারে আনা। সেটা করা যেতে পারত তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর্পোরেট কর হার কমানোর মাধ্যমে। সরকার নিজেও স্বীকার করে, বাংলাদেশে কর্পোরেট কর হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে বেশি।

কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেট প্রস্তাবনায় এ বিষয়ে কিছুই নেই। গত দশ বছরে কোনো ভালো কোম্পানি আইপিও বিক্রি করে ডিএসই-তে তালিকাভুক্ত হয়নি। অথচ অর্থনীতির বিবেচনায় অনেক ভালো কোম্পানি অনেক বড় বড় ব্যবসা করছে।

ওইসব কোম্পানি আজও কেন শেয়ারবাজারের বাইরে আছে সেটা কেউ তাদের জিজ্ঞাসা করেনি। কোনো ভালো কোম্পানিই শেয়ারবাজারে আসবে না, যদি তারা এ বাজারে না এসে বাইরে থাকতে পারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়ার জন্য যে কথিত প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব প্রণোদনা শেয়ারবাজারের ভালো না করে বরং ক্ষতি করবে।

ঢালাওভাবে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর বসানোর প্রস্তাব কোনো ভালো প্রণোদনা হতে পারে না। অনেক কোম্পানির স্টক ডিভিডেন্ড থেকে বিনিয়োগকারী বেশ ভালো উপকৃত হন। ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো Basel-এর শর্তাবলী পালন করতে গিয়ে স্টক ডিভিডেন্ড দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যদি স্টক ডিভিডেন্ড দেয় তাহলে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি উপকৃত হয়। একইভাবে এ বাজেটে রিটেইন্ড আর্নিংয়ের ওপর কর বসানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এটাও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।

আমরা আশা করি, সরকার এ দুটো কর প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করবে। শেয়ারবাজারের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনা সরকার খুঁজে না পেলে যা আছে তা-ই সরকার রেখে দিতে পারে।

আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ