আবদুর রহমান ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা। অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় আর্থিকখাতের যখন নাজুক অবস্থা তখন একমাত্র আশার আলো শেয়ারবাজার। বর্তমান কমিশন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটিসহ (বিডা) সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিনিয়োগ আকর্ষণে যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরছে। এ সব কার্যক্রমের ফলে করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশের পুঁজিবাজারে মানুষের আস্থা ফিরেছে। বিনিয়োগ বাড়ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৪ নভেম্বর লন্ডনে বিনিয়োগ আকর্ষণে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এই বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিনের অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনের শাসন এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করায় শেয়ারাবাজারের প্রতি ক্রমান্বয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে।

যা করোনার অভিঘাত কাটিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যদিও আইনের শাসন এবং জবাবদিহিতার অভাবে গত ১০ প্রায় বছর বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অথচ মাত্র ১ বছরের বর্তমান কমিশনের যুগান্তকারী পদক্ষেপে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক উত্থান হয়। গত মে মাসে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে ছিল দেশের পুঁজিবাজার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ডিএসই’র ইতিহাসে সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে প্রথম ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে।

এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে ফিরতে শুরু করছিলেন। বিদেশী বিনিয়োগ যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, দীর্ঘদিন পর পুঁজিবাজার নিয়ে যখন সবাই খুশি। তখনই দৃশ্যমান সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং সরকারকে বিব্রত করতে একটি গ্রুপ দেশের পুঁজিবাজারকে আবারও আগের মতো বিপর্যস্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আর এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গত মঙ্গলবারের (৩০ নভেম্বর) বৈঠকের পরের দিনই পুঁজিবাজারে ব্যাপক উত্থান হয়। এদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এসময় পুঁজিবাজার উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের পাশে আছেন বলেও জানান তিনি। ফলে আস্থা ফিরে পায় বিনিয়োগকারীরা। কিন্ত বুধবার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ে একটি লিখিত বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয় বৈঠকে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

যদিও বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয় ফলপ্রসূ মির্টিং হয়েছে। ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে। বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত বক্তব্য প্রকাশের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ফের হতাশার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেছেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র মতপার্থক্য না থাকলে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোন কারন নেই। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সা¤প্রতিক সময়ে এই দুই সংস্থার কিছুটা মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমতে পারে। বাজারে এর প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া বেশ কিছু কোম্পানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল। এসব কোম্পানির মূল্য সংশোধন হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন পর সবাই উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শেয়ার কিনছে। নতুন অনেক বিনিয়োগকারী আসছে। তাই পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে এটি আমরা আশা করিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে এরকম বৈঠক আগেও হয়েছে। এরপরে অর্থ মন্ত্রণালয় যেহেতু বৈঠক ডেকেছে।

আশা করছি সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা এবং ফাইনাল সিদ্ধান্ত হবে। এক্সপোজার লিমিট কস্ট প্রাইজে ধরবে নাকি মার্কেট প্রাইজে ধরবে এটিই আলোচনার মূখ্য বিষয়। আমি মনে করি কস্ট প্রাইজে ধরা ঠিক। তারা বিশ্বের অন্য পুঁজিবাজারগুলোও দেখতে পারে। কারণ বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও পুঁজিবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বড় অবদান রয়েছে। সেটার পরিমাণ এবং কিভাবে গণনা করে তা দেখতে পারে।

গত বছর করোনার মধ্যে সূচক যখন পড়তে শুরু করলো তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকগুলোকে শেয়ার ক্রয় করতে নির্দেশ দিয়েছিলো। এসময় প্রথমে সরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলো শেয়ার ক্রয় করলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ক্রয় করা শুরু করবে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তিতে ২০০ কোটি টাকার ফান্ড অনুমোদন দেওয়া হয়। আমি আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগীতা করা উচিত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যেই কার্যকর সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। অথচ ব্যাংকগুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আর্থিকখাতের তদারকি সংস্থাটি। আবার শেয়ারাবাজারে ছড়ি ঘোড়ানের চেষ্টা করছে। ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও নানা অনিয়মে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাতের এসব অনিয়ম রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা খুব একটা নেই বললেই চলে।অথচ তারা পুঁজিবাজার ইস্যুতে মাতামাতি করছেন। যা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল নয়।

এর আগেও ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা গিয়েছে। ২০১০ সালের শেয়ারবাজারে ধসের পর বিভিন্ন সময়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা, একক গ্রাহক ঋণসীমা ও বিনিয়োগ গণনা পদ্ধতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারিকৃত বিভিন্ন নির্দেশনার প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি ও মহামারীর প্রভাবে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত রীতিমতো ধুঁকছিল পুঁজিবাজার। সূচক নেমে এসেছিল ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্টে। করোনার সংক্রমণ রুখতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে বন্ধ হয়ে পড়েছিল পুঁজিবাজারে লেনদেনও।

আর তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনেন। গত বছর মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চেয়ারম্যান করে নতুন কমিশন নিয়োগ করে সরকার। নতুন কমিশনের উদ্যোগে সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে চালু হয় পুঁজিবাজারের লেনদেন।

নতুন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে আইনের শাসন, সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করায় পুঁজিবাজারে ক্রমান্বয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করে। গত বছরের জুলাই থেকেই ছন্দ ফিরে পেতে শুরু করে পুঁজিবাজার। সক্রিয় হতে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরাও।

পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বর্তমান বিএসইসি’র সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সব অংশীজনের সহযোগীতায় দীর্ঘ দিনের মন্দাভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে পুঁজিবাজার। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পুঁজিবাজার বিষয়ক যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে বিএসইসি বা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।

এবিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ কে এম মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং ক্যাপিটাল মার্কেটের বিপক্ষে গিয়েছে। তারঁ মতে- কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় পুঁজিবাজারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিতেই এসব প্রশ্নবিদ্ধ কার্যকলাপ করছে।সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়।

গত মঙ্গলবারের (৩০ নভেম্বর) বৈঠক শেষে বিএসইসি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফলপ্রসূ আলোচনার’ কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। অথচ বুধবারের বড় উত্থানের দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। এতে বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতেই পতন লক্ষ্য করা গেছে। পরে অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের খবরে বাজারে বড় উত্থান হয়েছে।

একটি শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আর্থিকখাতের যখন নাজুক অবস্থা তখন একমাত্র আশার আলো পুঁজিবাজার। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিকখাতের উন্নয়ন ঘটাতে না পেরে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে ক্ষোভের বশবর্তি হয়ে পুঁজিবাজারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। যা দেশের অর্থনীতিকে আরও বিপর্যস্ত করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক খারাপ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার প্রফেসর ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মুনাফা তুলে নিতে কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করছেন। এজন্য সূচক কিছুটা নিম্নমুখীতা দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ে কোন ধরণের ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না। দ্রুতই পুঁজিবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।