দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করপোরেট কর কমছে। একই সঙ্গে কমছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে কর। এছাড়াও প্রথমবারের মতো দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডেও কর অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত থাকছে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ককর ছাড়ের আওতা বাড়তে পারে এবং নিন্মস্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে আগামী বাজেটে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে বিনা প্রশ্নে পাচার হওয়া অর্থ সাদা করার সুযোগ দেবে সরকার। ফলে কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনে তবে দেশের অন্য কোনো আইনে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ বহু আগে থেকেই দিয়ে আসলেও বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ এবারই প্রথম দিচ্ছে সরকার। তবে এ সুবিধা শুধুমাত্র এক বছরের জন্যই দেওয়া হবে।

এ সুবিধার ফলে বাংলাদেশিরা বিদেশে তাদের সম্পদের তথ্য আয়ের বিবরণীতে যুক্ত করার সুযোগ পাবেন, ওই অর্থের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না।

জানা গেছে, এবারের বাজেটে তিনভাবে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দেয়া হবে। প্রথমত, বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি থাকলে সেই সম্পত্তি দেশের আয়কর রিটার্নে দেখাতে চাইলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ কর এবং তৃতীয়ত, কেউ বিদেশ থেকে টাকা দেশের আনলে সেই টাকার ওপর সাত শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবে টাকা যোগ হওয়ার আগেই কর পরিশোধ করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। এমনকি আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে না।

অপরদিকে দেশ থেকে যে টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা আবার দেশে ফেরানোর সুযোগ দিতে বাজেটের আগেও ঘোষণা আসতে পারে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন‘বিভিন্ন সময় যেসব টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে গেছে, আমরা বিভিন্নভাবে এসব টাকা ফেরতের সুযোগ দিতে অ্যামনেস্টি দিচ্ছি, যাতে টাকাগুলো আমাদের দেশে ফিরে আসে, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’

এছাড়াও আসন্ন বাজেটে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে এ ছাড় পেতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোকে শর্ত পূরণ করতে হবে। কোন কোম্পানি শর্ত পূরণ করতে না পারলে কর হার কমার পরিবর্তে আড়াই শতাংশ বাড়বে।

আড়াই শতাংশ কর ছাড়ের ক্ষেত্রে দুটি শর্ত থাকছে। একটি হচ্ছে- যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে বাজারে ছাড়া হয়েছে, তারাই কেবল এ সুবিধা পাবে। আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে বার্ষিক সর্বমোট ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ ব্যয় ও বিনিয়োগ ছাড়া সব ধরনের লেনদেন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া থাকলেও ওই কোম্পানিকে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিতে হবে।

এছাড়াও একক ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানির (ওপিসি) ক্ষেত্রেও একই শর্ত দিয়ে করপোরেট কর ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমানে এক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। অপরদিকে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় আনতে চলতি অর্থবছর বাজেটে কর ছাড় সুবিধা দেয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেও প্রতিবন্ধীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে একই ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কঠিন শর্তের বেড়াজালে এ সুবিধা নিতে পারেনি কোনো প্রতিষ্ঠানই। তাই আগামী বাজেটে শর্ত শিথিল করা হচ্ছে।

আগামী বাজেটে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ই-টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (প্রাপ্তি স্বীকার বা আয়কর সনদ) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। মূলত রিটার্ন দাখিল বাড়ানো ও করযোগ্য ব্যক্তিদের করের আওতায় আনতে বাজেটে এই ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে প্রায় ৪০ ধরনের সেবা নিতে হলে ই-টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক।

সূত্রমতে, বিপুলসংখ্যক করদাতা করনেটের বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) করমুক্ত আয় সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। সারচার্জ বা সম্পদ কর হারে পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। হাঁস-মুরগির খামারের মালিকদের ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত থাকলেও আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া আগের নিয়মেই হাঁস-মুরগি, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি এবং মৎস্য চাষ থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর আরোপ করা হচ্ছে।

অপরদিকে আগামী বাজেটেও ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড’ সুবিধা অব্যাহত রাখা হচ্ছে। দেশীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ও দেশীয় পণ্যকে ব্র্যান্ডিং করার অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড’ সুবিধা চালু করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর সুবিধা দেওয়া হয়। তবে আগামী বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড’ প্রতিষ্ঠায় নতুন করে আরও বেশ কিছু দেশীয় শিল্প খাতকে কর সুবিধা দেয়া হবে।

এ ছাড়া করোনা-পরবর্তী ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। চলতি বাজেটে অটোমোবাইল, থ্রি হুইলার, ফোর হুইলার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও হালকা প্রকৌশল শিল্পকে ১০ বছর কর অব্যাহতি দেয়া হয়।

এছাড়াও বেশকিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হলেও এবার তা বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। ব্যবসা পর্যায়ে মোবাইল সেটের ওপর বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে।

আবার কয়েকটি খাতে ভ্যাট হার কমানো হচ্ছে। এর মধ্যে হোটেল-রেস্টুরেন্টের ভ্যাট কমানো হচ্ছে। বর্তমানে এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ১০ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্টুরেন্টে খেতে পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। আসন্ন বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। অপরদিকে জুয়েলারি শিল্পের ভ্যাট দুই শতাংশ কমিয়ে তিন শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।

ভ্যাট রিটার্ন দাখিলে (দাখিলপত্র) ব্যর্থতার জরিমানাও পাঁচ হাজার টাকা করা হচ্ছে, যেখানে বর্তমানে জরিমানার পরিমাণ ১০ হাজার টাকা। আর ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা ও অনিয়মের ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে।

আগামী বাজেটে জীবনযাত্রার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। ফলে আসন্ন বাজেটে জনগণের ওপর নতুন করে করের বোঝা চাপানো হবে না বলে জানিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষের কষ্ট বা ভোগান্তি যাতে করে না বাড়ে এবং তাদের ওপরে যেন বোঝা বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, এগুলো কমবেশি বিবেচনায় নেব। নতুন বাজেট আরও স্বচ্ছ উপায়ে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।

আগামী ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট হবে এটি। এ বাজেটের আকার হবে ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর খাতে এক লাখ ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, শুল্ক খাতে ৪২ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, মূসক খাতে দুই লাখ চার হাজার ৭৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে পাঁচ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।