দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে ছিল বেশ টালমাতাল। সূচক কমার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে লেনদেন তলানিতে নেমেছে। বাজার পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি ইতিবাচক ধারায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। লেনদেন তলানিতে নামলেও সরকারি বন্ড চালু হওয়ার দিন থেকে বাজার মূলধনে নতুন ইতিহাস গড়েছে, তা পরবর্তীতে ধরে রাখতে পারেনি। বাজারে ঘন ঘন উত্থান পতনের কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগকারীরা। তবে বৈশ্বিক মন্দা কিছুটা কেটে গেলে দেশের পুঁজিবাজার ভবিষ্যতে আরও সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হয়েছে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাজারের জন্য ইতিবাচক নানা পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছিল। যার ফলে অতীতে যেসব বিনিয়োগকারী বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বাজারে বিনিয়োগ বাড়ায় বিনিয়োগকারীরা।

যার ফলে ২০২১ সালে লেনদেনে, সূচক, বাজার মূলধনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ওই বছরে বাজারে সূচক বেড়েছে সাড়ে ১২০০ পয়েন্ট। কিন্তু তা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। ধীরে ধীরে বাজার ফের নেতিবাচক ধারায় রূপ নেই। এর ধারাবাহিকতায় বাজারে ২০২২ সালে সূচক ৫৯৬ পয়েন্ট কমেছে। অসাধু চক্র বাজার নিয়ে খেলায় মেতে উঠার কারণে এক ধরনের অস্থিরতার দেখা দিয়েছে শেয়ারবাজারে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে লেনদেন নেতিবাচক ধারায় চলতে থাকলে তাকে ফ্লোর প্রাইজ দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করা হয়েছে। ফ্লোর প্রাইজ সাময়িক সময়ের জন্য ভালো হলেও দীর্ঘমেয়াদী কোনও ভালো ফল বয়ে আনে না। ফ্লোর প্রাইজ আরোপ করার পরও পতন থামানো সম্ভব হয়নি। বাজারের লেনদেন তলানিতে নেমে গেছে। তবে এসময় বাজারে কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিন্তু অসাধু চক্রের কারণে কোনওটিই টেকেনি। সরকারি সিকিউরিটিজ চালুর ফলে বাজার মূলধন বেড়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু মন্দা বাজারে মূলধনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এতদিন বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। ফলে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে বৈশ্বিক মন্দা কিছুটা কেটে গেলে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ আরও সম্ভাবনাময় বলে মনে করছেন তারা।

এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজারের যে স্বাভাবিক মুভমেন্ট করার কথা সেটা হচ্ছে না। ফ্লোর প্রাইজে আটকে আছে বাজার। তাতে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে পারলেও বিক্রি করতে পারছে না। এতে বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন।

তিনি বলেন, নিজস্ব গতিতে পুঁজিবাজারকে চলতে দিতে হবে। ফ্লোর প্রাইজ উঠানো হলে লেনদেনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তবে তার নিজস্ব গতি থাকবে। বর্তমান মন্দা বাজার পরিস্থিতিতে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতেও বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা কমে গেছে। তাতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ছে। দিন দিন বাজার অনিশ্চয়তায় দিকেই যাচ্ছে। ফ্লোর প্রাইজ উঠিয়ে দিয়ে কমিশনের মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। যাতে কেউ বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বিএসইসির।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে ডিএসইতে ২৪৪ কার্যদিবসে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২,৩৪৪,৪৭৯.৩৭ মিলিয়ন টাকা৷ যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন৷ যার গড় লেনদেন ৯,৬০৮.৫২ মিলিয়ন টাকা৷ এর আগে ২০১০ সালে গড় লেনদেন ছিল ১৬,৪৩৪.০৭ মিলিয়ন টাকা এবং ২০২১ সালে গড় লেনদেন ছিল ১৪,৭৫২.২০ মিলিয়ন টাকা৷

২০২২ সালের শুরুতে ২ জানুয়ারি প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিলো ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্টে। এ ছাড়া ডিএসই শরিয়াহ সূচক ছিলো ১ হাজার ৪৪৫ পয়েন্টে এবং ডিএস ৩০ সূচক ছিল ২ হাজার ৫৬০ পয়েন্টে। বছরের শেষ দিকে গত বৃহস্পতিবার ২৯ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্টে এবং ডিএসই শরিয়াহ সূচক কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৫৮ পয়েন্টে। তবে ডিএস ৩০ সূচক দাঁড়িয়েছে ছিলো ২ হাজার ১৯৫ পয়েন্টে।

অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) বছরের শুরুতে ২ জানুয়ারি সিএএসপিআই সূচক ছিলো ২০ হাজার ৫৪ পয়েন্টে। এ ছাড়া সিএসসিএক্স ছিলো ১২ হাজার ৪৬ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ছিল ১৪ হাজার ৫৯ পয়েন্টে। বছরের শেষ দিকে গত ১৫ ডিসেম্বর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে।

এ ছাড়া সিএসসিএক্স কমে ১১ হাজার ৫৩ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৫৫ পয়েন্টে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে সিএএসপিআই সূচক কমেছে ১৬০০ পয়েন্টে, সিএসসিএক্স কমেছে ৯৯৩ পয়েন্ট এবং সিএসই৩০ সূচক কমেছে ৮০৪ পয়েন্টে।

বছরের শুরুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ছিলো ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সরকারি সিকিউরিটিজ চালুর দুই দিন পর ১২ অক্টোবর সর্বোচ্চ বাজার মূলধন ছিলো ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর গত ১৫ ডিসেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

এদিকে, বছরের শুরুতে সিএসইতে বাজার মূলধন ছিলো ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। পরবর্তীতে সিএসইতে সরকারি বন্ড চালুর দিন ১০ অক্টোবর বাজার মূলধনের সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছিল। ওইদিন বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৮১০ কোটি ২৭ লাখ ৬ হাজার টাকা। গত ১৫ ডিসেম্বর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৭১৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।