দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। ফরিদপুরে রাজত্ব করেছেন টানা এক যুগ। সেখানকার রাজনীতি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চলত তার কথায়। মূল পদে না থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগে তার ওপর কথা বলার উপায় ছিল না। জাতীয় পর্যায়েও কম দাপট ছিল না। মন্ত্রিসভায় প্রভাবশালীদের তালিকায় রাখা হতো তার নাম। তবে এখন আর নেই সেই দিন। বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। একে একে হারিয়েছেন প্রায় সব। ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য।

পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে ওঠায় ২০২০ সালে ফরিদপুর ছাড়েন। সর্বশেষ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ পড়েন। এর আগে ২০১৮ সালে মন্ত্রিত্ব হারালেও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই পদটিও কেড়ে নেওয়া হলো তার।

নানা কারণে আলোচিত খন্দকার মোশাররফ হোসেন দেশে নেই প্রায় ৯ মাস। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মেয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। কবে নাগাদ দেশে ফিরবেন, সে বিষয়ে নিজেও নিশ্চিত নন।

সোমবার টেলিফোন আলাপে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি নিজেই তো বলেছি, অবসর নিতে চাই। আমার বয়স এখন ৮০ বছর। যে কাজটা সুষ্ঠুভাবে করতে পারব না, সেটা ধরে রেখে তো কোনো লাভ নেই। এখন নতুন লোক আসুক। তারা করুক, আমি তো অনেক দিন করলামই।

আমি তো কোনো গাফলতি করিনি আমার কাজে। আমি একটা পদ ধরে রেখে দেব, কিন্তু ঠিকমতো করতে পারব না, এটা তো ঠিক হবে না। দেড় বছর ধরে আমি ফরিদপুর যেতে পারছি না। এখানে চিকিৎসা করাচ্ছি। আমি তো কোনো খারাপ কাজ করিনি। আমি আমার মতো আছি। যেটা আমি করতে পারতেছি না, সেটা ধরে রাখার দরকার কী?’

রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেই রাজনীতিতে থাকতে চাচ্ছি না। আমার বিরুদ্ধে তো কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। কোনো আন্দোলন নেই, কোনো বদনাম নেই। আমার বয়স হয়ে গেছে। কাজেই যে কাজটা আমি সুষ্ঠুভাবে করতে পারব না, সেই কাজের মধ্যে লেগে থেকে তো কোনো লাভ নেই।

যেটা পরিষ্কারভাবে করতে পারব না, সেটার দায়িত্ব নিয়ে গোলমাল করা তো ঠিক হবে না। নিজে একটু ফ্রি থাকতে চাই। নিজের শেষ বয়সে নাতি-নাতনি, সন্তানদের সঙ্গে থাকতে চাই। তবে তোমাদের বিপদে-আপদে, সুখে-শান্তিতে মরার আগের দিন পর্যন্ত থাকব।’

কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে আমার চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হলে দেশে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’সংবিধানের ৬৭(১) ধারার খ উপধারা অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য সংসদের অনুমতি ছাড়া টানা ৯০ বৈঠক-দিবস অনুপস্থিত থাকলে তার আসন শূন্য হয়ে যাবে।

জানা গেছে, গত বছরের ৬ এপ্রিল খন্দকার মোশাররফ হোসেন সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে সোমবার পর্যন্ত সংসদের তিনটি অধিবেশনের ৪১টি বৈঠকে তিনি যোগদান করেননি। এই অনুপস্থিতির জন্য স্পিকারকে কিছু অবহিতও করেননি। তবে অনুপস্থিতির ৯০ কার্যদিবস পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ নেই। সংসদের বর্তমান মেয়াদের শেষ দিকে অনুপস্থিতি সম্পর্কিত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি সামনে আসতে পারে।

তবে জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আসন শূন্য হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে সেক্ষেত্রে তার আসনে উপনির্বাচন না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর আগামী জাতীয় নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ আসনে খন্দকার মোশাররফ হোসেন যে মনোনয়ন পাচ্ছেন না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সব দিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় খন্দকার মোশাররফ এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন, কয়েক বছর আগেও এ কথা কল্পনা করতে পারেনি কেউ।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ওই বছর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও বিএনপি নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের কাছে হেরে যান। ২০০১ সালের নির্বাচনেও জিততে পারেননি। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৃতীয়বারের চেষ্টায় জয়লাভ করেন খন্দকার মোশাররফ।

২০০৯ সালে তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সরিয়ে খন্দকার মোশাররফকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে কিছু দিনের জন্য তাকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভা থেকেই বাদ পড়েন। তবে সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ায় অব্যাহত থাকে তার আগের দাপট। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে তাকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই ফরিদপুর আওয়ামী লীগে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্যাগী নেতাদের পরিবর্তে তার অনুসারীরা পেয়ে যান গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই সময় তিনি নিজে ছিলেন জেলা কমিটির এক নম্বর সদস্য। তার অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল সরকারের উন্নয়ন কাজের দরপত্র। তাদের বিরুদ্ধে বারবার চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠে। দল ও প্রশাসনের কারোই মোশাররফের নির্দেশের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না।

তবে ২০২০ সালের ১৬ মে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার অভিযোগে মামলা দায়েরের পর বদলে যেতে থাকে প্রেক্ষাপট। এর ২২ দিন পর ৭ জুন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ফরিদপুর শহরের বদরপুর এলাকার বাসায় বিশেষ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তার দুই ঘনিষ্ঠ সহচর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবলকে। প্রথমে সুবল সাহার বাড়িতে হামলার অভিযোগে মামলা করা হলেও পরে তাদের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়।

জানা গেছে, বাসায় অভিযানের দুদিন পর খন্দকার মোশাররফ ঢাকায় চলে আসেন। পরে ওই বছরের ১৪ জুলাই এবং ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মাত্র দুবার কয়েক ঘণ্টার জন্য ফরিদপুরে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাকে আর ফরিদপুরে দেখা যায়নি।

গত বছরের ৭ মার্চ রাতে মোশাররফের ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন তার সহকারী একান্ত সচিব ও জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক এ এইচ এম ফুয়াদ। দুজনকেই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গত বছরের ১২ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে বাদ পড়েন মোশাররফপন্থিরা। তিনি নিজেও জেলা কমিটির সদস্য পদ হারান। এরপর ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলনে তাকে দলের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত রোববার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ থেকে বাদ পড়েন খন্দকার মোশাররফ।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, ‘খন্দকার মোশাররফ হোসেন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। উন্নয়ন কাজও বেশি। এসব কাজের তদারকির দায়িত্ব সংসদীয় স্থায়ী কমিটির; কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে বয়সের ভারে কমিটির সভায় যোগ দিতে পারছেন না। এ কারণেই তার পরিবর্তে নতুন সভাপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’

দলের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কোনো বদ্ধ জলাশয় নয়। নতুনরা আসবে, পুরোনোরা বাদ যাবে—এটাই রীতি। দলীয় পদে কেউ সব সময় থাকবেন–এমনটা নয়।’

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইশতিয়াক আরিফ বলেন, ‘খন্দকার মোশাররফ হোসেন যেসব পদে ছিলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগই তাকে সেসব পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। এখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে তিনি পদ হারাচ্ছেন। সিদ্ধান্তগুলো সঠিক এবং যথাসময়েই নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্তের প্রতি জেলা আওয়ামী লীগ শ্রদ্ধাশীল।’ সূত্র: কালবেলা