দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত নতুন প্রজন্মের তিন ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা আছেন চরম বিপাকে। চলতি বছর আইপিও-এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসা ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ার কিনে এখন মূলধন হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন ব্যাংক তিনটির শেয়ার কেনা বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে ব্যাংক তিনটির মধ্যে ২টি শেয়ার মূল্য ফেস ভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। এর মধ্যে সদ্য পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করে পুঁজি নিয়ে দু:শ্চিন্তায়।

পাবলিক ইস্যু রুলস-২০১৫ অনুযায়ী বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ব্যাংক তিনটি আইপিও-এর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার অনুমতি দিয়েছে। এদের মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক পুঁজিবাজার থেকে ৪২৮ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এ জন্য তারা ৪২ কোটি ৮০ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যু করে।

এছাড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ৪২৫ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করে। এই টাকা তুলতে কোম্পানিটি ৪২ কোটি ৫০ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যু করে। এছাড়া মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেড পুঁজিবাজার থেকে ৭০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এজন্য তারা ৭ কোটি সাধারণ শেয়ার ইস্যু করে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এই তিন ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই। ফলে ক্রেতা সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় লসে শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের তদারকি অভাবে অনেক দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে। এরপর আইপিও’র মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়ার পর তাদের দুর্বলতাগুলো বেরি আসছে। এসব দুর্বল কোম্পানির পুঁজিবাজারে আসার কারণে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দিন শেষে যার মাশুল গুনতে হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ১৬ নভেম্বর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। লেনদেন শুরুর দিনই শেয়ারটি এক টাকা বা ১০ শতাংশ কমে ৯ টাকায় নামে। ওইদিন ব্যাংকটির প্রতিটি শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্য উঠেছিল ৯ টাকা ৮০ পয়সা। লেনদেন হয়েছিল ১১ হাজার ৮১৭ বারে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬১টি শেয়ার। যার বাজার মূল্য ছিল ২১ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রায়।মঙ্গলবারও শেয়ারটি সেই ৯ টাকায় লেনদেন হয়েছে। তবে ১৩ বারে মাত্র ২১ হাজার ৭৪৬টি শেয়ার হাত বদল হয়েছে।

কোম্পানিটি ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ৪২৫ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করে। এই টাকা তুলতে কোম্পানিটি ৪২ কোটি ৫০ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যু করে।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের আইপিও শেয়ার পাওয়া বিনিয়োগকারী শরিফুল ইসলাম বলেন, লেনদেনের প্রথম দিনই শেয়ারটি ফেস ভ্যালুর নিচে চলে গেছে। ১০ টাকার শেয়ার এখন ৯ টাকা। এরপরও ক্রেতা নেই। এখন না পারছি রাখতে না পারছি বিক্রি করতে। বলা যায় এটা এখন আমার গলায় কাঁটা। প্রায় একই কথা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা রমিজ উদ্দিন আহমেদ নামে আরেক বিনিয়োগকারী। তার ভাষায়, যেকোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়ার সময় বিএসইসি যাচাই-বাছাই করে না বলেই এই অবস্থা।

একই অবস্থা ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডারদের। ব্যাংকটির অভিহিত মূল্যের নিচে পড়ে আছে। এই কোম্পানিটি চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু করে। অভিহিত মূল্য ১০টাকা হলেও মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) শেয়ারটির ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৯ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ারে ৭০ পয়সা লসে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

মিডলান্ড ব্যাংকের শেয়ারে গত বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২ টায় ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩ টি শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও কোনো ক্রেতা ছিল না।এর মধ্যে ১০.২০ টাকা দরে ১২ লাখ ৩ হাজার ১৬৯টি শেয়ার বিক্রেতা ছিল। অন্যরা ১০.২০ টাকা থেকে ১১.৩০ টাকা দরে বিক্রি করার বিনিয়োগকারী ছিল।

অনেক বিনিয়োগকারীই এ শেয়ারটি কিনে বিপাকে পড়েছেন বলে জানান। আইপিওতে শেয়ার পাওয়া এক বিনিয়োগকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকটির আইপিওতে আবেদন করাই ছিল বড় ভুল। শেয়ার কিনে এভাবে আটকে যাব জানলে এ শেয়ারে বিনিয়োগ করতাম না। এ ব্যাপারে মিডল্যান্ড ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি খালিদ মোহাম্মদ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির দ্বিতীয় দিনেই ফ্লোর প্রাইসে বা সর্বনিম্ন মূল্যসীমায় গেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংক মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ার। ৩৫তম ব্যাংক হিসেবে গত সোমবার দেশের দুই শেয়ারবাজারে ব্যাংকটি তালিকাভুক্ত হয়। প্রথম দিনে এর সমাপনী মূল্য ছিল ১০ টাকা ২০ পয়সা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বেঁধে দেওয়া নিয়মে এ দরেই শেয়ারটির ফ্লোর প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার লেনদেনের পুরো সময় ফ্লোর প্রাইসে কেনাবেচা হয়েছে শেয়ারটি। গত বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবারও ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন পায়। তবে ব্যাংকটির এক পরিচালকের ঋণখেলাপীর অভিযোগ থাকায় এর শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে ভাটা পড়ে। আইপিও আন্ডারসাবসক্রাইব হয়। অনেক বিনিয়োগকারীই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারটি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তাই ফ্লোর প্রাইসে আটকে বরং বিনিয়োগকারীদের বড় লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, গত সোমবার সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে লেনদেনের শুরুতে মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ারের চাহিদা কম ছিল। আইপিও প্রক্রিয়ায় ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারটির লেনদেন হয় ৯ টাকায়। একপর্যায়ে হঠাৎ ১০ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত দর ওঠে। তবে শেষ আধা ঘণ্টার লেনদেনের ভারিত গড় মূল্যের হিসাবে এর সমাপনী মূল্য নির্ধারিত হয় ১০ টাকা ২০ পয়সা।

ফ্লোর প্রাইসে আটকে যাওয়ায় প্রথম দিনের তুলনায় লেনদেনও কমেছে। সোমবার প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ২২ লাখ ৭২ হাজার ৩৯৫টি শেয়ার মোট সোয়া ২ কোটি টাকায় কেনাবেচা হয়। গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংকটির ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪২৭টি শেয়ার কেনাবেচা হয় ৮৮ লাখ টাকায়। গত বুধবার কেনাবেচা কমেছে চারগুণ। বুধবার মিডল্যান্ড ব্যাংকের মোট ৪৯ হাজার ৫৮৯টি শেয়ার লেনদেন হয়। অর্থাৎ এ শেয়ারের লেনদেনে ধস নেমেছে। বিনিয়োগকারীরা এ শেয়ারটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

২০২১ সালে ব্যাংকটি মাত্র ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। এ শেয়ারের পিই রেশিও ২৩ দশমিক ১৮। অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে যা অনেক বেশি। সাধারণত পিই ১৫-এর উপরে গেলেই ওই শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। ব্যাংকটির স্বল্পমেয়াদী ঋণ রয়েছে ৫৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

একটি ব্রোকার হাউজের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এই তিনটি ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই এসে কান্নাকাটি করছেন। ব্যাংক তিনটিতে বিনিয়োগ করে চরম হতাশায় রয়েছেন তারা। তারা বলছেন, এমন দুর্বল ব্যাংক কিভাবে আইপিওতে এলো তা বোধগম্য হচ্ছে না। বিএসইসি কর্মকর্তারা তাদের কি দেখে অনুমোদন দিয়েছে বুঝতে পারছি না।