স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারসহ বিএসইসির নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বরং দিন যতই যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা ততই ভারী হচ্ছে। ফলে সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।

বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।

এছাড়া নির্বাচনী ইস্যু কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় দরপতনের মুখে পড়েছে পুঁজিবাজার। তবে চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবস বড় ধরনের দরপতনে বিপর্যয়ে পড়েছে বাজার দুটি। তবে মঙ্গলবার কিছুটা সূচকের উত্থান হলেও লেনদেন মন্ধাভাব ছিলো।

তেমনি এ অবস্থার মধ্যে আজ সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে সূচকের বড় দরপতন হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সামনের দিনগুলোতে আরো বড় ধরনের দরপতন হবে। এই শঙ্কায় শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা বলে জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
তেমনি পোর্টফলিও ম্যানেজারসহ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বর্তমানে সাইডলাইনে থেকে বাজার পর্যবেক্ষণে বেশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া, বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী। এছাড়া রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত অনেকে মার্জিন লোন নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পরিণতিতে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না।

তবে পুঁজিবাজারের হঠাৎ এ দরপতকে সরলভাবে নিতে পারছেন না দক্ষ বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি, পুঁজিবাজারের এ দরপতনের পেছনে আবারও কোনো কারসাজি চক্র সক্রিয়, নাকি নির্বাচন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি জামায়াত পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে চায় তা দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খতিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগকারীরা আবারও বড় লোকসানের মুখে পড়বেন।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, পুঁজিবাজার খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখন মার্চেন্ট ব্যাংক, আইসিবিকে হাল ধরতে হবে। তা না হলে শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর চাপিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। পুঁজিবাজারে মন্দা দীর্ঘ হলে ক্ষতি যেটা হয় তা হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা অস্থির হয়ে যান। তারা মুনাফার চেয়ে শেয়ার বিক্রি করে লোকসান কমিয়ে আনা কিংবা সমন্বয় করতে চান। কিন্তু প্রতিনিয়ত দর পড়তে থাকলে সমন্বয় করাও বন্ধ করে দেন। ফলে লেনদেন প্রতিনিয়ত কমে আসে।

পুঁজিবাজার হঠাৎ দরপতন হওয়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ বিদ্যমান বলে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এবং বড় ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথায় এ তিনটি কারণ উঠে এসেছে।

প্রথমত, নির্বাচন সামনে রেখে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কোনো কোনো মহল। তারা বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে বা বিনিয়োগ উঠিয়ে ফেলার জন্য গুজব ছড়াচ্ছে যে, সামনে শেয়ারের দাম আরও কমবে। এগুজবের সাথে ডিএসই বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজ জড়িত। এরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পুঁজিবাজার ইস্যুতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ ব্যাপারে বিএসইসি’র সজাগ থাকা উচিত। তা না হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজারে প্রকৃত বিনিয়োগকারী যারা নিজেদের সঞ্চয়ের অর্থ নিয়ে আসে, তাদের সংখ্যা কম। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর একটা বড় অংশই ঋণ নির্ভর, তারা মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করছেন। ফলে বাজার পড়ে গেলে এই ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক তৈরি হয়। এটি বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি করে।

তৃতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে নতুন বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে আসছে না। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দুর্বল মৌল ভিত্তি শেয়ারের দর বাড়ায় আর ভাল মৌল ভিত্তি শেয়ার এক বছরের বেশি সময় আটকে থাকায় বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের নৈতিবাচক ধারনা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে নেই বললেই চলে। এছাড়া মার্কেট প্লেয়ার যারা, তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করছে কি না বিএসইসির সেটা দেখা উচিত।

এদিকে আজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক কমেছে ১৮ পয়েন্ট। আরেক বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক কমেছে ৩৯ পয়েন্ট। আজ বিমা, প্রকৌশল এবং বস্ত্র খাতসহ অধিকাংশ খাতের শেয়ারের দাম কমেছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, আজ বাজারে ৩২৪টি প্রতিষ্ঠানের মোট ৮ কোটি ৬৫ লাখ ৮৩ হাজার ২৪১ শেয়ার ও ইউনিট ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে। এতে লেনদেন হয়েছে ৪১৮ কোটি ৮৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩৮৫ কোটি ৭৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ আগের দিনের চেয়ে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। এদিন দাম বেড়েছে মাত্র ৩৭টি কোম্পানির শেয়ারের, বিপরীতে কমেছে ১৩২টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫৫টির।

আজ প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৮.৫৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ২৯৬.৯৯ পয়েন্টে। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ২.০৬ পয়েন্ট এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৬.০৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৩৬৯.০৩ পয়েন্টে এবং দুই হাজার ১৪২.৭৭ পয়েন্টে। আজ ডিএসইতে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৪১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার। যা আগের কার্যদিবস থেকে ৩৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা বেশি। আগের কার্যদিবস লেনদেন হয়েছিল ৩৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার।

ডিএসইতে আজ ৩২৪টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৩৭টির বা ১১.৪২ শতাংশের। এছাড়া দর কমেছে ১৩২টির বা ৪০.৭৪ শতাংশের এবং শেয়ার দর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫৫টির বা ৪৭.৮৪ শতাংশের।

অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩৯.৬০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৬২২.৯৪ পয়েন্টে। সিএসইর অপর সূচকগুলো মধ্যে সিএসসিএক্স ২৩.৩৪ পয়েন্ট, সিএসই-৫০ সূচক ০.৭৫ পয়েন্ট এবং সিএসআই ২.০১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ১৩৩.০৬ পয়েন্টে, এক হাজার ৩০৯.৯০ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ১৭০.৩৬ পয়েন্টে।

তবে সিএসই-৩০ সূচক ৩.৫৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩৬৩.৩৯ পয়েন্টে। সিএসইতে আজ ১৫৮টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এদের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ২০টির, কমেছে ৮৮টির এবং ৫০টি কোম্পানির শেয়ার দর অপরিবর্তিত রয়েছে। আজ সিএসইতে মোট ৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।