বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ইতোমধ্যে নিজেদের জাহির করতে মহানগরের অলিগলিতে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকারীদের একত্রিত করছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে অরাজকতা তৈরি করার নীলনকশা কষছে। কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে। এদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে। এসব তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তবে সানজিদুল ইসলাম ইমন এবং তারেক সাঈদ মামুন দুজন মিলেই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিলেন এমন অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এরকম অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের দুইজনই বিচারের মুখোমুখি হন এবং বিচারে তাদের শাস্তি হয়েছে।

সম্প্রতি ২৬ বছর কারাদণ্ড ভোগ করে মামুন মুক্তি পান। ইমন কারাগারে ছিলেন। আন্ডারওয়ার্ল্ড এর এই দুই সক্রিয় সদস্যের মধ্যে কারাগারের মধ্যেই বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকায়। সম্প্রতি ইমন বাহিনী তারেক সাঈদ মামুনের ওপর হামলা পরিচালনা করে। তেজগাঁওয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ফিল্ম স্টাইলে আক্রমণ, গুলি এবং হামলা চালানো হয় মামুনের ওপর।

মামুন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় একজন নিরীহ পথচারী আইনজীবী গুরুতর আহত অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। আর এর ফলে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছেন, নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে এই আন্ডারওয়ার্ল্ড এর সক্রিয় তৎপরতা সবসময় বাড়ে। এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়।

তারেক সাঈদ মামুন এবং সানজিদুল ইসলাম ইমন দুজনেই মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। একাধিক হত্যা মামলার আসামি তারা। এরা দুজনই কারান্তরীণ ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে মামুন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন এবং নতুন করে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ড সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এটি কারাগারে জানানো হয় ইমনকে।

এর ফলে ইমন বাহিনী সক্রিয় হয় এবং মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হলেও এই সমস্ত আন্ডারওয়ার্ল্ড এর অস্থিরতার কারণে যেকোনো সময় ঢাকায় বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে।

শুধু ইমন এবং মামুন নয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য এখন আন্ডারওয়ার্ল্ড এর সদস্যরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে ক্যাসিনো অভিযানের পরে আন্ডারওয়ার্ল্ড এর বেশ কিছু সদস্য গ্রেপ্তার হন এবং কেউ কেউ পালিয়ে যায়। সেই সময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে যারা কর্তৃত্ব করত তাদের একটি বড় অংশই সরকারের সাঁঁড়াশি অভিযানের পর নিস্কিয় হয় যান।

এখন তারা আবার সরব হওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে বিকাশ বাহিনীও ঢাকাতে আবার শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। বিকাশ বিদেশে পালিয়ে গেলেও তার বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। বিকাশ-প্রকাশ বাহিনী ঢাকার একটি অঞ্চল কর্তৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও সুইডেন আসলামের হাতে গড়া যে সন্ত্রাসী গ্রুপ তারাও এখন নির্বাচনের আগে সক্রিয় হচ্ছেন।

তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল বিষয়টি হল ২০০৮ নির্বাচনের পর আস্তে আস্তে ঢাকার পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ড এর কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল একজন যুবলীগ নেতার হাতে এবং তার কর্তৃত্বে অন্যান্য আন্ডারওয়ার্ল্ড এর যে সমস্ত সন্ত্রাসী চক্র ছিল তারা কোণঠাসা হয় পড়েন এবং পুরো ঢাকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন ওই যুবলীগ নেতা। কিন্তু তিনি এখন নিস্কিয় হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডে একটা নতুন মেরু করণ হচ্ছে।

সূত্র মতে, দীর্ঘদিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অপরাধী ভারত, মালয়েশিয়া, দুবাই, ইতালি, কানাডা, লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকাসহ নানা দেশে আত্মগোপন করে আছে। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। এসব নিয়ে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। চলছে পাল্টাপালটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজধানী ঢাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ তৎপর। প্রায়ই ঘটছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা।

এক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে রাজধানীর চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হচ্ছে মিছিল-মিটিংয়ে। তাদের জন্য স্থানীয় নেতাদের পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাও করছে। চিহ্নিত এসব সন্ত্রাসীর গতিবিধি নজরদারি করছেন গোয়েন্দারা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবৈধ অস্ত্র আমদানিও বেড়েছে। প্রায়ই সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র জব্দ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা অনেকেই প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নির্বাচনের আগে পরিকল্পনা মাফিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করবে।

দুবাইয়ে অবস্থানরত বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত মোস্ট ওয়ান্টেড শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ওরফে মন্টি ওরফে হাজি সাহেব সারা দেশেই তার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জাল ছড়িয়ে রেখেছেন। বিশাল বাহিনীর গডফাদার জিসান সরাসরি কোনো রাজনৈতিক পার্টিকে সমর্থন করেন না। তার অনুসারীদের দাবি, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে তিনি সে সরকারেরই লোক।

বিগত সময়ে রাজধানীতে সন্ত্রাসী কায়দায় যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার সিংহভাগই জিসানের কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ে হয়েছে। রাজধানীতে তার প্রধান সহযোগীদের মধ্য রয়েছে মতিঝিল, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, বনানী এলাকার রুবেল, খালেদ, সাঈদ, শাহজাদা, মোক্তার, রবিন, ডালিম, রমজান, মান্নান ও আসিফ। নির্বাচনে সহিংসতা ঘটানোর আগেই তার সহযোগীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাজত্ব আর এখন নেই। যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যে কজন রয়েছে তাদের অবস্থান হয় বিদেশে নয়তো কারাগারে। এসব সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে মাঝে মধ্যে কিছু চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। পরে আমরা তা প্রতিহতও করছি।

বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে র‌্যাব প্রস্তুত রয়েছে। সন্ত্রাসীরা কোনোক্রমে দেশে এলে র‌্যাবের গোয়েন্দাজালে আটকা পড়বেই। এসব সন্ত্রাসীর তালিকা হালনাগাদও করা হচ্ছে ।