দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারী চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ‘কি পয়েন্ট ইন্সটুলেশন’ (কেপিআই)-ভুক্ত প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাতে পারে। সম্প্রতি এ আশঙ্কা প্রকাশ করে সেখানকার নিরাপত্তা জোরদার করতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণভবন, বঙ্গভবন এবং জাতির পিতার সমাধিস্থলসহ সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ ৫৮৪টি স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

পাশাপাশি কোন কেপিআইয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন তা সরেজমিন যাচাই করে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কার্যালয়ে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে। একই সঙ্গে কেপিআইগুলোতে গতানুগতিক ব্যবস্থার বাইরে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ সফটওয়্যার। এর মাধ্যমে সারা দেশের সব কেপিআইয়ের নিরাপত্তার নির্দেশনা দেয়া যাবে এক ক্লিকেই। সফটওয়্যারটির নাম দেয়া হয়েছে ‘কেপিআই ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার’ বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, দেশকে চরম অস্থিতিশীল করতে একটি পক্ষ দেশে ও বিদেশে নানা ধরনের চক্রান্ত করছে। এর প্রতিফলনও ঘটছে বহির্বিশ্বের নানা ধরনের তৎপরতায়। তাদের এমন কর্মকাণ্ডে উজ্জীবিত সরকার বিরোধী পক্ষগুলো। তারাও বিভিন্ন সময় নানা ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙা করছেন।

ধারণা করা হচ্ছে, এ থেকে উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গুপ্ত হামলা চালিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এডিশনাল ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সতর্ক রয়েছে। বিশেষ সময়কে সামনে রেখে সুযোগসন্ধানীরা নাশকতার চেষ্টা করে থাকে।

গোয়েন্দা তথ্য আছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন প্রকল্প বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে ‘টার্গেট’ করতে পারে নাশকতাকারী চক্র। এ কারণে এসব এলাকায় পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি, সিসি ক্যামেরায় নজরদারি এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্য বাড়ানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন ওই গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ইতিমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশুগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট, মোংলা ও পায়রা বন্দরে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। লোকবলের ঘাটতি সত্ত্বেও বিশেষ নজরদারি অব্যাহত আছে।

অপর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ভবন, দফতর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাস ও কয়লা ক্ষেত্র, ইপিজেডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত এলাকায় নিরাপত্তা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা বৃদ্ধির বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানান হয়েছে। তিনি বলেন, কেপিআই এলাকার কোথাও কোথাও বাইরের সাধারণ লোকদের যাতায়াত করার সুযোগ নেই। এসব এলাকায় উন্নয়ন কেন্দ্রের দেশীয় লোকদের পাশাপাশি বিদেশি লোকদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি।

এ কারণে নিরাপত্তার অজুহাত যেন কেউ তুলতে না পারে বিষয়টি মাথায় রেখেই অ্যাডভান্স ইনটেলিজেন্সের অংশ হিসেবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। প্রায় ৬০০ স্থাপনা বিভিন্ন ক্যাটাগরির আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষ নজর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর। তিনি জানান, নাশকতা করতে পারে এমন অনেকে গোয়েন্দা জালে রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া সমন্বিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকার নতুন ভিসানীতিতে উজ্জীবিত বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো। এরপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে মিশন নিয়ে চক্রান্ত। বিএনপি নেতাকর্মীদের ধারণা এসব চক্রান্ত তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ করবে। এ ধারণা থেকে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ফলে তাদের মাঝে নতুন করে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। এ থকে তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাতে পারে। এমনকি দেশে আইনের শাসন নেই বলেও তারা প্রচার চালাচ্ছে।

এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পর তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হলে সে বিষয়গুলো হাতিয়ার করে নতুন চক্রান্তে মেতে উঠতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বহির্বিশ্বে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ার কারণে তার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারগুলোতেও। এতে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে বিএনপি ও জামায়াত নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। এছাড়া দেশে এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোডশেডিং। যা আগের দুই সপ্তাহের তুলনায় অনেক কমে এসেছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানান দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। তাছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে।

কেপিআইয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এ বিষয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সব সময়ই একটু ভিন্ন রকমের থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বলেই এ বিষয়ে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা গোপন রাখা হয়। কেপিআইয়ের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রাখার সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, জরুরি মুহূর্তে কার কী দায়িত্ব তা নিরূপণ করে ইভাকুয়েশন প্ল্যান আধুনিকায়ন করতে জোর দেয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মহড়ার পাশাপাশি বাড়াতে বলা হয়েছে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি। শুধু তাই নয়; কেপিআইগুলোতে গতানুগতিক ব্যবস্থার বাইরে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ সফটওয়্যার। এর মাধ্যমে সারা দেশের সব কেপিআইয়ের নিরাপত্তার নির্দেশনা দেয়া যাবে এক ক্লিকেই।

সফটওয়্যারটির নাম দেয়া হয়েছে কেপিআই ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার। এ সফটওয়্যারে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) জাহিদ হোসেন ভূঁইয়াকে। গত ২২ জুন এর উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম। সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্ভরযোগ্য জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, কেপিআই ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় এসবি সদর দপ্তর থেকে ৬৪টি জেলার এসপি, মেট্রোপলিটন উপকমিশনার (ডিসি) এবং কেপিআই-এর দায়িত্বশীলদের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। পাশাপাশি সব কেপিআই প্রধান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার ই-মেইল এবং টেলিফোনে নিয়মিত নতুন নতুন বার্তা দেয়া হচ্ছে। এসবি প্রধানের পক্ষে এসব বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন একজন পুলিশ সুপার।

সূত্র আরও জানায়, কেপিআই ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার উদ্বোধনের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক প্রতিবেদন আসে এসবি সদর দপ্তরে। আর কেপিআই ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে এসবি সদর দপ্তর থেকে দেয়া হয়েছে দুই হাজারের বেশি নির্দেশনা।

কেপিআইয়ের নিরাপত্তাসংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি তদারকি ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। যেসব কেপিআইয়ের সীমানা নির্ধারিত করা নেই সেগুলোর সঠিক সীমানা নির্ধারণ করে দ্রুত প্রাচীর দিতে হবে। আগের দেয়া যেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি সেগুলো ত্বরিত বাস্তবায়ন করতে হবে। কেপিআইয়ের আশপাশে অবৈধ দখলদাররা যেসব স্থাপনা নির্মাণ করেছে সে বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সব কেপিআইকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনার পাশাপাশি এর মেমোরি কমপক্ষে এক বছর সিডিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্থাপনার নিরাপত্তায় পুরো এলাকা ফ্ল্যাড লাইট অথবা সার্চ লাইট দিয়ে আলোকিত করে রাখতে হবে। নষ্ট সিসি ক্যামেরা চালু ও জনবল বাড়াতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, সব কেপিআইয়ের জন্য নিরাপত্তা কমিটি গঠন করতে হবে। যেসব কেপিআইয়ে কমিটি নেই সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কেপিআই নীতিমালা অনুযায়ী নিয়মিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠাতে হবে।

প্রাত্যহিক ঘটনা নোট বইয়ে লিপিবদ্ধ করতে হবে। যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল সেখানে দ্রুত প্রহরা চৌকি স্থাপন করতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে কোনো দর্শনার্থী আগমন করলে তাদের নাম-ঠিকানা, আগমন ও প্রস্থানের তারিখ, সময়, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ ও রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। কেপিআইয়ে কর্মরতদের নিরাপত্তা পাস চালু রাখতে হবে।