দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও জোটের হিসাব-নিকাশের কারণে শেষ পর্যন্ত নৌকা প্রতীক পাবেন কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচালে পড়েছেন আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক প্রার্থী। বিশেষ করে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর পাশাপাশি জাতীয় পার্টিকে বিগত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে সব আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সে আসনগুলোর প্রার্থীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

এর বাইরে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন কিংস পার্টি-খ্যাত কয়েকটি দল ও বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আসা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। তারা যেসব আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন সেসব আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন বলে দলীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।

শরিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করায় নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেবে নাকি একলা লড়তে হবে, এ বিষয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন আওয়ামী লীগের শরিক ও মিত্র দলগুলোর নেতারা। তবে সোমবার তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, জোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পর আসন সমন্বয় করা হবে। এর পরদিন মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৩০০ আসনেই দলীয় প্রার্থী দেবে আওয়ামী লীগ।

তবে সমঝোতা হলে জোটকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের তারিখ ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাতে সময় আছে। দলের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্যের পর দলীয় মনোনয়ন পাওয়া অর্ধশতাধিক প্রার্থীর মধ্যে বাদ পড়ার আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। কারণ নির্বাচনে জোট ও মিত্রদের আসন ছাড়তে হলে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়বেন দলের হেভিওয়েট প্রার্থীরাও।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট শরিক দলগুলোর মধ্যে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জাসদ (ইনু) ৩টি আসন, জাসদ (আম্বিয়া) ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, জেপি মঞ্জু ১টি ও তরিকত ফেডারেশন ১টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এ ছাড়া বিকল্প ধারা নৌকা নিয়ে ২টি আসনে জয়ী হয়। এবার ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দুটিতে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি।

এর মধ্যে কুষ্টিয়া-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ১৪ দলের অন্যতম শরিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আর নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে জাতীয় পার্টির এ কে এম সেলিম ওসমান বর্তমান সংসদ সদস্য। ২৯৮টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের যে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে ঢাকা-৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয় দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিমকে। এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

তিনি নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। মেনন এই আসন থেকে এবারও প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে দলের সিনিয়র নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ায় এই আসন আওয়ামী লীগ ছাড়তেও পারে আবার নাও ছাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে মেননকে তার আগের আসন বরিশাল-২ থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত করতে পারেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস।

রাজশাহী-২ আসনে বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। সেখানে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে মোহাম্মদ আলীকে। আর সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ফেনী-১ আসন থেকে নৌকা নিয়ে দুইবারের সংসদ সদস্য। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম।

তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর চট্টগ্রাম-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে খাদিজাতুল আনোয়ারকে। জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কানাই লাল বিশ্বাস। মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বর্তমান এমপি বিকল্পধারার মাহি বি চৌধুরী। এ আসনে মহিউদ্দিন আহমেদকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এখানে তৃণমূল বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে চাইছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিম হুদাও। বিকল্প ধারার মহাসচিব বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে ফরিদুন্নাহার লাইলীকে। জোট হলে এসব আসনে জোট শরিক দলগুলোর বর্তমান সংসদ সদস্যরাই নৌকা প্রতীক পাবেন বলে মনে করছেন শরিক দলগুলোর নেতারা।

ফলে এসব আসনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও নির্বাচন থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা কাজ করছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মধ্যে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিও ২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। দলটি ইতিমধ্যে ২৮৭ আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করলেও তাকিয়ে আছে আওয়ামী লীগের দিকে। তারাও চাইছে গত নির্বাচনে যে সব আসনে জাপার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিল গত নির্বাচনের মতো এবারও সেসব আসনে নৌকার কোনো প্রার্থী যাতে না থাকে।

সে ক্ষেত্রে জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের কপাল পুড়তে পারে। এ ছাড়া লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মতিয়ার রহমান।

জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের ময়মনসিংহ-৪ আসনে মহিবুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে কোনো প্রার্থী না দিলেও এবার সেখানে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন নাসিরুল ইসলাম। জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চট্টগ্রাম-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য। সেখানে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে আবদুস সালামকে। ফলে সমঝোতা হলে এসব আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে বাদ পড়তে পারেন।

১৪ দলীয় জোট ও মহাজোটের বাইরে এবার নতুন যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি নতুন দল। বিশেষ করে তৃণমূল বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) ও তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। এই দুই আসনেই আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে।

সমঝোতা হলে এই দুটি আসন তৃণমূল বিএনপিকে ছেড়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবার নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর ও বাসাইল) আসনে নির্বাচন করবেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য অনুপম শাজাহান জয়। এ আসনটিও আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিতে পারে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়তে ঢাকার দুটি আসন (ঢাকা-৫ ও ঢাকা-১৪) থেকে মনোনয়নপত্র কিনেছেন বিএনপি জোটের আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আলোচনায় আসা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ঢাকার ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক কাউন্সিলর কাজী মনিরুল ইসলাম। এবার এই আসনে সাবেক সংসদ সদস্য হারুনর রশীদকে (মুন্না) দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

আর ঢাকা-১৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান। ফলে আওয়ামী লীগ কল্যাণ পার্টিকে একটি আসনে ছাড় দিলে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও নির্বাচন থেকে বাদ পড়তে হবে একজনকে। এর বাইরেও কয়েকটি ইসলামি দল এবং কিংস পার্টি-খ্যাত বিএসপিকেও দুয়েকটি আসনে ছাড় দিতে পারে ক্ষমতাসীন দলটি।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত নয়। একক নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া এ তালিকার মাধ্যমে জোট শরিকদের কিছুটা চাপে রাখা হয়েছে যাতে তারা বেশি আসন চাইতে না পারে। এখন পর্যন্ত প্রতীক বরাদ্দ না হওয়ায় মনোনয়ন পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে।

৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া শেষ হলে প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত আসন সমঝোতার সুযোগ রয়েছে। একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে যারা বর্তমানে এমপি রয়েছেন তাদের আসনগুলো এবারও ছেড়ে দেবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, জোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পর আসন সমন্বয় করা হবে। আওয়ামী লীগ জোটগতভাবেই নির্বাচন করবে।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ বা জোটনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এখনও কোনো কথা হয়নি। তবে আলোচনা করেই সবকিছু ঠিক করা হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের নৌকা প্রতীক নিয়ে যে কয়টি আসনে মনোনয়ন দেবেন সেখানে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন তারা। আর বাকি কিছু আসনে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রার্থী থাকবে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আসন বণ্টন নিয়ে এখনও চূড়ান্ত কিছু হয়নি।

আওয়ামী লীগ সব আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও সমঝোতার মাধ্যমে জোট শরিকদের কিছু আসন ছেড়ে দেবে বলে তারা আশাবাদী। ১৪ দল জোটবদ্ধভাবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। সমঝোতা হলে জোটকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।