দেশ প্রতিক্ষণ, ভোলা: ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন উপজেলা মনপুরার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তাল মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় মনপুরা দ্বীপে। এ রুটে যাতায়াতের সরকারি একমাত্র নির্ভরযোগ্য নৌযান একটি সি-ট্রাক থাকলেও তা নিয়মিত চলাচল করছে না।

নানা অজুহাতে সেটি ছয় মাসের বেশি সময় বন্ধ রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে সাধারণ যাত্রীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট ট্রলারে উত্তাল মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে চলাচল করছেন। এমন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলেও যাত্রীরা নিরুপায় হয়ে ট্রলারে যাতায়াত করছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ট্রলারমালিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে পরিকল্পিতভাবে বেশি মুনাফা লাভের আশায় সি-ট্রাকটি অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখেন ইজারাদার। এর ফলে ভোগান্তির শেষ নেই দ্বীপ উপজেলা মনপুরার দেড় লক্ষাধিক বাসিন্দার। উপায় না পেয়ে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে বাধ্য হয়ে অবৈধ ট্রলার বা স্পিডবোটে যাতায়াত করতে হচ্ছে তাদের।

সরেজমিনে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা সি-ট্রাক ঘাটে গেলে কথা হয় সাধারণ যাত্রী ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারা জানান, এই রুটের যাত্রীদের নিরাপদে যাতায়াতের জন্য বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ‘এসটি শহিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত’ নামে একটি সি-ট্রাক। কিন্তু নানা অজুহাতে ‘ইয়ানুর এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ইজারাদার প্রতিষ্ঠান নিয়মিত সি-ট্রাকটি চলাচ্ছে না।

এদিকে ইঞ্জিল বিকল থাকার অজুহাতে সি-ট্রাকটি বন্ধ থাকায় প্রতিনিয়ত বাধ্য হয়ে ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে যাতায়াত করছেন এ রুটে চলাচলকারী নারী, শিশু থেকে শুরু করে অসুস্থ রোগীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তাই বর্তমানে একদিকে যেমন জীবনের ঝুঁকি থাকছে, অন্যদিকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এখানকার মানুষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মনপুরার হাজিরহাট থেকে অন্তত দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে তজুমদ্দিন ঘাটে এসে পৌঁছায়। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, নারী ও শিশুরা ছিলেন।

মানুষের পাশাপাশি ট্রলারে গৃহনির্মাণসামগ্রী, মাছের ঝুড়ি, সবজির বস্তাসহ ছাগল ও হাঁস-মুরগি দেখা গেছে। শত শত যাত্রী আর মালামাল নিয়ে ট্রলারগুলো উত্তাল মেঘনা পাড়ি দেওয়ার সময় চরম আতঙ্কে থাকেন বলে জানান যাত্রীরা।

মনপুরা থেকে ট্রলারে আসা যাত্রী ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি মহিউদ্দিন পাটোয়ারী জানান, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রতি মাসের প্রায় অর্ধেকের সময় এ সি-ট্রাকটি বন্ধ থাকে। ফলে অফিসের কাজে বাধ্য হয়েই ট্রলারে নদী পারাপার করতে হয় তাদের।

ব্যবসায়ী ফিরোজ উদ্দিন ও সিকান্দার মিয়া জানান, ট্রলারে মালামাল পরিবহন করা খুবই ঝঁকিপূর্ণ। মেঘনার ঢেউয়ের পানি উঠে প্রায়ই মালামাল ভিজে যায়। এভাবে তাদের অনেক লোকসান গুনতে হয়। যাত্রী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, এই রুটে সি-ট্রাক এবং ট্রলারে যাত্রীদের কাছ থেকে ১৮০ টাকা করে একই পরিমাণ ভাড়া নেওয়া হয়। এমনকি যৌথভাবে সি-ট্রাক এবং ট্রলার পরিচালনা করেন একই ব্যক্তিরা। তাই জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় তারা সমঝোতা করে পরিকল্পিতভাবে বেশি মুনাফা লাভের আশায় সি-ট্রাকটি বন্ধ রাখেন।

গত জুন থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাতে প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সি-ট্রাকটি বন্ধ রয়েছে। এই সুযোগে ট্রলারমালিকরা বাড়তি ভাড়ায় নদী পারাপারে বাধ্য করেন যাত্রীদের। তারা বলেন, ট্রলারে জ্বালানি খরচ অনুযায়ী যাত্রীপ্রতি ১০০ টাকার বেশি ভাড়া হওয়ার সুযোগ নেই।

মনপুরা-তজুমউদ্দিন রুটে যাত্রীদের হয়রানি ও ভোগান্তি কমাতে এবং দুর্ঘটনা রোধে নিয়মিত সি-ট্রাক চালু ও এই রুটে নতুন সি-ট্রাক দেওয়ার দাবি জানান মনপুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেলিনা আক্তার চৌধুরী।

ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ‘ইয়ানুর এন্টারপ্রাইজ’ প্রতিনিধি মো. হেলাল জানান, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সি-ট্রাকটি বন্ধ রয়েছে। এই রুটের জন্য যে সি-ট্রাকটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত পুরোনো। তাই অল্পতেই ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। তাই মনপুরা-তজুমদ্দিন রুটে নতুন একটি সি-ট্রাক দেওয়া হলে এই সমস্যার সমাধান হবে।

বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক (ভোলা নদী বন্দর) শহিদুল ইসলাম জানান, গুরুত্বপূর্ণ এই নৌরুটে যাত্রীদের নিরাপদে চলাচলের জন্য উন্নত সি-ট্রাক দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবৈধভাবে সি-সার্ভেবিহীন নৌযান চলাচলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌরুটে শিগগিরই সি-ট্রাকটি চালু করার পাশাপাশি অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এ ছাড়া বিষয়টি সমাধানের জন্য বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ও পরিচালক অপারেশনকে অবহিত করা হয়েছে।