মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই বাঙালির হৃদয়ে যখন এই গান বাজে, রাস্তায় বেরোলে তাকে দেখতে হয় ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড। রাজধানীর ধানমণ্ডি, মতিঝিল, গুলশান, বারিধারা থেকে ডুমনীর কোনো গলি, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কিংবা সুদূর সেন্ট মার্টিন কোথায় নেই ইংরেজি সাইনবোর্ড।

এ ব্যাপারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা উপেক্ষিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলার ব্যবহার হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টের নির্দেশনা মানছে না। মানতে বাধ্য করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এদিকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। তারপর ১০ বছর পার হলেও সাইনবোর্ডে উপেক্ষিতই রয়ে গেছে বাংলা ভাষা।

ঢাকার শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাইনবোর্ডগুলোতে ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন। ইংরেজি ভাষার ‘বিত্তবৈভবে’ বাংলা যেন ধুলায় হারাচ্ছে। বাংলা বর্ণমালা খুঁজে পাচ্ছে না তার গন্তব্য। বিশিষ্টজনরা বলছেন, রক্তরাঙা পথে যে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন শহিদরা, তার প্রতি এমন অবহেলার পেছনে কাজ করছে দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা। হীন মানসিকতা থেকেই ইংরেজিকে প্রাধান্য দিতে চাইছেন কেউ কেউ, যা উচিত নয়।

রাজধানীর অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে এ ধরনের প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। বনানী, গুলশান, বেইলি রোডসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠাগুলোর সাইনোবোর্ডে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেও বাংলার ঠাঁই হচ্ছে না। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশনা হলো: সাইনবোর্ডে ইংরেজি থাকতে পারবে, কিন্তু বাংলা থাকতেই হবে। অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা জায়গা পেয়েছে, তবে তা অত্যন্ত অবহেলিতভাবে। বেইলি রোডে একটি ভবনে দেখা গেল, সব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডই ইংরেজিতে লেখা।

পুরো ভবনের গায়ে কোনো বাংলা অক্ষরের অস্তিত্ব চোখে পড়ল না। একই সড়কের কেএফসি রেস্টুরেন্ট যে ভবনে, সেই ভবনে কেএফসি ও পিৎজাহাট ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় চোখে পড়েনি। কেএফসি ও পিৎজাহাটের সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাও স্থান পেয়েছে। বাকি ভবনগুলোরও একই অবস্থা। একই অবস্থা দেখা গেল বনানীর ব্যস্ততম ১১ নম্বর রোডে ও গুলশান অ্যাভিনিউয়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন কেউ যেন বাংলাকে সেভাবে প্রাধান্য দিচ্ছে না। যেন মনে হয় বাংলায় লিখলে একটু নিচু হয়ে গেলাম কিংবা অবদমিত হয়ে গেলাম। তাই তারা ইংরেজি ব্যবহার করতে চায়। যদিও বিশ্বায়নের যুগে যোগাযোগে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য আছে, তবে সে ক্ষেত্রেও প্রত্যাশা একটাই- আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন। মূল কাঠামোতে অবশ্যই বাংলার প্রধান্য হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল। ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। কিন্তু মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আদালতের ভাষা হিসেবে পারিনি, উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও পারিনি, সন্তানের নামকরণের ক্ষেত্রেও পারিনি। অথবা আমাদের কেনাকাটার জন্য যেসব বিপণিবিতান দৃশ্যমান হয়, সেখানেও মাতৃভাষায় লিখনটাকে নিশ্চিত করতে পারিনি।

এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, এটা প্রমাণ করে যে আমরা মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে আন্তরিক নই। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে পুরোপুরি ব্যর্থ এবং রাষ্ট্র ও সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলেই হয়। যে দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দল এখন ক্ষমতায়। তারা অন্ততপক্ষে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু সেই প্রত্যাশার পূরণ তারা করতে পারেনি।

এদিকে হাইকোর্টের নির্দেশনা ঠিকভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে কি না, সেটি তদারকি করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি)। সংস্থা দুটি মাঝে মাঝেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। তবে ফেব্রুয়ারিতে এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ আদালত বেশি দেখা যায়। আদালত বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ জরিমানা করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কিন্তু এবার সেই অভিযানও নেই।

এ ব্যাপারে ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বলেন, আমরা যখন ট্রেড লাইসেন্স দিই তখন শর্তে সব উল্লেখ করা থাকে যে সাইনবোর্ডের সাইজ কত হবে, সাইনবোর্ডে অবশ্যই বাংলা লেখা থাকতে হবে। এই শর্ত মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতে শুধু ফেব্রুয়ারি মাস নয়, সারা বছরই আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকি। এটা আমাদের রুটিন কাজ।

এবার কেন ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছেন না জানতে চাইলে ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, এবার অভিযান কেন নেই সেটা বলতে পারব না। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। তবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি।