আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ১৪ বছরেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে নির্মাণ হয়নি ভাষা শহীদ স্মৃতি জাদুঘর। ২০১০ সালে ভাষা সৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরি করে জাদুঘর নির্মাণ করা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণসহ ৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট। তবে এখনো সেই আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

ভাষা আন্দোলনের ৫৮ বছর পরেও ২০১০ সালে আইনজীবী মনজিল মোরসেদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ভাষা জাদুঘর নির্মাণ, বাংলা ও ইংরেজীতে ভাষা আন্দোলনের তথ্য সংরক্ষণসহ ৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট। কিন্তু ১৪ বছর অতিবাহিত হলেও আলোর মুখ দেখেনি আদালতের নির্দেশনা। তবে এত বছর পর ভাষা সৈনিকদের তালিকা করার প্রয়োজন দেখছেন না ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

জানা গেছে, হাইকোর্টের আদেশের এক যুগেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও নির্মিত হয়নি ভাষা শহিদদের স্মৃতি রক্ষায় ‘ভাষা শহিদ স্মৃতি জাদুঘর’। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। রিটের শুনানি শেষে ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাশে জাদুঘরটি নির্মাণের আদেশ দেন হাইকোর্ট।

জাদুঘর নির্মাণের পাশাপাশি সেখানে সার্বক্ষণিক গাইড নিয়োগ, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস সন্নিবেশ করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ব্রুশিয়ার তৈরিসহ আট দফা নির্দেশনাও ছিল ওই আদেশে। কিন্তু এর দু-একটি ছাড়া বাকিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি আজও। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার সংস্কৃতি ও পূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষকে আদালতে তলব করা হলেও আজও অবহেলিত হাইকোর্টের রায়।

আদালতের রায়ে ছিল ভাষা সৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার নির্দেশনাও। আর রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলছেন, শুরুতেই অসম্পূর্ণ একটি তালিকা হলেও পরে সেটি আর সম্পূর্ণ করা হয়নি। তবে তালিকা প্রস্তুত কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মনে করছেন, কালের পরিক্রমায় যে সময় হারিয়ে গেছে তা খুঁড়ে আর ভাষা সৈনিকদের তালিকা করার প্রয়োজন নেই।

বাংলা নয় বরং উর্দুই হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর এমন ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল বাঙালি। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করে ছাত্র ও জনতা। এতে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও নাম না জানা অনেকেই। এরপর তাদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেলের পাশে নির্মিত হয় শহিদ মিনার।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহিদ মিনারের পাশে আদালতের নির্দেশনার আলোকে কোন ‘ভাষা শহিদ স্মৃতি জাদুঘর’ এখনো স্থাপন করা হয়নি। বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য নেই কোনো তথ্যবহুল নির্দেশনা। দূর থেকে আসা সাধারণ দর্শনার্থীসহ কারও জন্য নেই কোনো শৌচাগার। শহিদ মিনারে প্রবেশের ক্ষেত্রে জুতা নিয়ে কতটুকু যাওয়া যাবে তার জন্য নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। যদিও হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছে, মূলবেদিতে জুতা নিয়ে ওঠা যাবে না।

কিন্তু মূলবেদির সীমানা কোন সিঁড়ি থেকে শুরু তার দিকনির্দেশনা দেয়া নাই। যার ফলে অনেকেই জুতা নিয়ে শহিদ মিনারে প্রবেশ করছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে স্লোগান নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের দাবি শহিদ মিনার চত্বরে প্রবেশের পর প্রথম সিঁড়ি থেকেই কেউ জুতা নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু তাদের এ দাবি অনেকেই মানছেন না। তাছাড়া জুতা রেখে শহিদ মিনারে প্রবেশের ক্ষেত্রে জুতা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। এ বিষয়টি সমাধানের জন্য তারা সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়ে আসছে।

এ প্রসঙ্গে স্লোগানের সমন্বয়ক আসাদুজ্জামান বলেন, হাইকোর্টের আদেশ সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন তো হয়নি বরং আদালতের আদেশ মোতাবেক মূলবেদিতে জুতা নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না, সেটিও অনেকে মানছেন না। তারা মনে করেন মূলবেদি মানে মিনারের পাশের কয়েক ধাপ সিঁড়ি এবং লাল চিহ্নিত অংশটুকু। তারা ওই পর্যন্ত জুতা নিয়ে প্রবেশ করে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য হচ্ছে শহিদ মিনার চত্বরে প্রবেশের পর যেখান থেকে সিঁড়ির প্রথম ধাপ, সেখানে জুতা রেখেই সবাই প্রবেশ করুক। এ নিয়ে আমরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। প্রশাসন আমাদের দাবির প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপই করছে না।

দর্শনার্থীদের জন্য নেই বিশ্রামাগার ও শৌচাগার: কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রিয়াদ হাসান জানান, শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, সারা বছরই দেখাশোনা ও পরিষ্কার করে রাখা হয়। তবে এটা ঠিক যে, সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য কোনো বিশ্রামাগার ও শৌচাগার নেই। অনেক সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ শহিদ মিনার দেখতে আসে। কিন্তু প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তাদেরকে দূরে যেতে হয়। তাছাড়া পুরো চত্বরটি খোলা থাকায় অনেক সময় ভবঘুরেরা আসে। ঝড় বৃষ্টির দিনে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা না থাকায় বিব্রত হয় দর্শনার্থীরা।

এ বিষয় জানতে চাইলে ক্ষোভ জানিয়ে এ মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ বিষয়ে বলেন, জাদুঘর নির্মাণ করা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণসহ হাইকোর্টের আট দফা নির্দেশনা দেয়ার দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পার হলেও এখনো অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়নি। শহিদ মিনারের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেটুকু দায়িত্ব আছে, সেটা তারা কেন পালন করছে না, তা বোধগম্য হচ্ছে না। আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করলে আবারও আদালতে অবমাননার মামলা করা হবে।

আদালতের আট দফা নির্দেশনা: আদালতের রায়ে দেয়া আদেশে শহিদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসসমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষা সংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা তৈরি ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেয়া হয়।

নির্দেশনাগুলো হলো: জীবিত ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো এবং সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান; কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের নির্ধারিত এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা ও অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া; শহিদ মিনারের মূলবেদিতে কোনো ধরনের মিটিং, মিছিল, পদচারণা, আমরণ অনশন বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তবে ফেব্রুয়ারি মাসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলতে এবং ভাষা সৈনিকসহ জাতীয় ব্যক্তিত্বদের মরদেহে সর্বস্তরের জনগণের সম্মান প্রদর্শনের জন্য শহিদ মিনারের মূলবেদি ব্যবহার বা বিশেষ দিনে ফুল দেয়া এবং বেদির পাদদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা না রাখা; ভাষা শহিদদের সবাইকে মরণোত্তর জাতীয় পদক এবং জীবিতদের জাতীয় পদক দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া;

জীবিত ভাষা সৈনিকদের কেউ যদি সরকারের কাছে আবেদন করে, তাহলে তাদের ‘যথাযথ আর্থিক সাহায্য এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা’ করা; সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ভাষা সৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি এবং জেলায় জেলায় জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করবেন। কমিটির সদস্য হবেন- ভাষা সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযোদ্ধারা; বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণ ও সংরক্ষণ করা।

এ নির্দেশনার পর কয়েক দফা সময় নিয়েও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ওই রায় পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ওই সময় সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারা আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেন।

তখন আদালত তাদের ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গ্রন্থাগারসহ ভাষা শহিদ জাদুঘর স্থাপন এবং ভাষা সংগ্রামীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নসহ রায় বাস্তবায়নে নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৭ সালে আবারও আদালত অবমাননার অভিযোগে মামলা করলে রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানায়। তারপর আরও দুই বছর কেটে যায়। আজও পূর্ণাঙ্গ রায় বাস্তবায়ন করা হয়নি।