মোহাম্মদ সিরাজুল মনির, দেশ প্রতিক্ষণ, চট্টগ্রাম: বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ড্রেজিং কোম্পানিগুলোর নজর এখন বাংলাদেশে। বহুল প্রত্যাশার বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে তারা ড্রেজিং করতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে তাদের এই আগ্রহের কথা সরকারকে জানিয়েছে। পৃথিবীর একাধিক বড় বড় কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে তাদের সক্ষমতার ব্যাপারে প্রেজেন্টেশন দিয়ে গেছে। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজ হবে। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই এই কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। এতে কোনো বিশেষ কোম্পানিকে পছন্দ করা বা সুবিধা দেয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হালিশহরের উপকূলীয় এলাকার ৯৩৯ একর ভূমিসহ সাগর ভরাট করে গড়ে তোলা প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে বে টার্মিনাল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ের বহু কাজই হয়ে গেছে। কিছুটা শ্লথ হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার পাওয়া এই প্রকল্পের আওতায় গড়ে উঠা বন্দরকে দেশের আগামীর ১শ’ বছরের বন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

হালিশহর উপকূলের একটি চরকে ঘিরে গড়ে তুলতে যাওয়া প্রকল্পটিতে চ্যানেল তৈরির পাশাপাশি সাগর থেকে মাটি তুলে দেড় হাজার একরের বেশি ভূমিও তৈরি করা হবে। সিংগাপুরের আদলে সাগর ভরাট করে উদ্ধার করে আনা ভূমিতেই নির্মিত হবে বে টার্মিনালের অবকাঠামো। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রিক্লেইমের ঘটনা হবে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

ড্রেজিং করে ১৬ মিটার গভীর চ্যানেল তৈরি করতে লাখ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হবে। যেনো তেনো ড্রেজিং কোম্পানির পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হবে না। এজন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ দিতে হবে। প্রস্তাবিত এই বন্দরকে ঠিকঠাকভাবে পরিচালনার জন্য বঙ্গোপসাগরে বাঁধ দিয়ে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হবে। ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরির কাজটি খুবই ব্যয়বহুল।

বিশ্বব্যাংক এই দুইটি কাজের জন্য অর্থায়ন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরির জন্য যত টাকারই প্রয়োজন হোক না কেন তার পুরোটাই বিশ্বব্যাংক যোগান দেবে বলে ইতোমধ্যে সরকারকে জানিয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে যে চ্যানেল তৈরি এবং ব্রেকওয়াটার নির্মাণে অন্তত সাড়ে তিনশ’ মিলিয়ন ডলার বা চার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। বিশ্বব্যাংক এই টাকার পুরোটার যোগান দেয়ার কথা রয়েছে।

অপরদিকে ইতোমধ্যে চালু হওয়া মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য ১৬ মিটার গভীর করে একটি চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। এই চ্যানেলটি পাশে আড়াইশ’ মিটার। এটির প্রস্থ সাড়ে তিনশ’ মিটারে উন্নীত করতে প্রচুর ড্রেজিং করতে হবে। একই সাথে চ্যানেলটির গভীরতা ধরে রাখতেও চালাতে হবে নিয়মিত ড্রেজিং। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকেও লাখ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালু উত্তোলন করা হবে। বড় ধরনের এসব ড্রেজিং কাজের জন্যও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ড্রেজিং কোম্পানিকে নিয়োগ দিতে হবে।

বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় ধরনের ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনার এ খবর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় ড্রেজিং কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। তারা চট্টগ্রামে এসে এসব কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করেছে।

মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়ামের দুইটি বিখ্যাত ড্রেজিং কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়ে গেছে। তারা তাদের কাজের ধরণ, সক্ষমতা, কোথায় কোথায় ইতোমধ্যে কাজ করেছে তার বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে গেছে।

বেলজিয়ামের জান্ডেনুল এবং নেদারল্যান্ডসের ভঙ্খালিস চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশান প্রদান করে। দুইটি কোম্পানিই কাজ দুইটি করার মতো সক্ষমতা তাদের রয়েছে বলে জানিয়ে গেছে। এছাড়া আরো কয়েকটি কোম্পানিও ইতোমধ্যে আগ্রহ দেখিয়েছে। তারাও চট্টগ্রাম বন্দরে এসে তাদের সক্ষমতার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত দিয়ে যেতে চায় বলেও সূত্র জানিয়েছে।

তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী টার্মিনালে প্রচুর ড্রেজিং করতে হবে। প্রকল্পব্যয়ের একটি বড় অংশ ড্রেজিং খাতে খরচ হবে বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, এই খাতের যাবতীয় ব্যয় বিশ্বব্যাংক প্রদান করবে। বিশ্বব্যাংকের কোনো প্রকল্পের কাজ ইচ্ছে করলে বা পছন্দ করলেই কাউকে দিয়ে দেয়া যাবে না। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে।

সরকার বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সরাসরি মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী টার্মিনালের ব্যাপারে আগ্রহী বলেও তারা জানান।

এই ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ড্রেজিং কোম্পানিগুলোর আগ্রহের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, অতি সম্প্রতি বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসের দুইটি কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে প্রেজেন্টেশান দিয়ে গেছে।