তৌফিক ইসলাম, আলগীর হোসেন ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নাগরিকদের স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলার সুবিধার জন্য ফুটপাত তৈরি করেছে সরকার। রাস্তা ও ফুটপাত দখল করা যেনো একটি সাধারণ ব্যাপার। যে যার ইচ্ছামতো ফুটপাত দখল করেন। কেউ আবার ফুটপাত ভাড়া দিয়ে টাকাও তোলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাস্তা বা ফুটপাতের উপরে বিভিন্ন দোকান বসানো হয়, আবার বাড়ির নির্মাণ সামগ্রী রাখা হয় রাস্তা দখল করে। কোনো কোনো জায়গায় তো রাস্তার উপরেই নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত রড সোজা করা এবং সিমেন্ট এবং বালু মাখানোর কাজও করা হয়।

এতে যেমন পথচারীদের হাঁটায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয় আবার গাড়ি চলাচলের গতিও কমে যায়। সিটি কর্পোরেশন বহুবার রাস্তা ও ফুটপাতের উপর দোকান সরানোর জন্য অভিযান পরিচালিত করেছে। কিন্তু, ফলাফল শূন্যই থেকে গেছে। শূন্য থাকার পেছনে অবশ্য কিছু কারণও রয়েছে। বড় কারণ প্রভাবশালীদের প্রভাব। কেননা, তারাই টাকার বিনিময়ে ফুটপাতে হকার বসার সুযোগ করে দেন।

কিন্তু, যারা আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন বানান, তারা নিজেরা প্রভাবশালী। তাই রাস্তা-ফুটপাত দখল করে নির্মাণ সামগ্রী রাখতে তাদের কারো কাছে জিজ্ঞাস করতে হয় না। বরং কেউ কিছু বলতে গেলে নিজেরাই বিপদে পরেন। ফলে এই ধরনের দখলের সংখ্যাও প্রচুর বাড়ছে। তেমনি গুলিস্তান রাজধানীর ব্যস্ততম অথচ চরম বিশৃঙ্খল একটি জায়গার নাম। যানবাহনের এলোমেলো চলা, আর ফুটপাত জুড়ে নানা পণ্যের পসরা এই নিয়ে গুলিস্তান।

বিশেষ করে, হকাদের দখলে এখানকার ফুটপাতগুলো এমনভাবে ঢেকে গেছে যে, পথচারীদের জন্য হাঁটার জায়গা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। পুলিশের সহায়তায় মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চললেও অভিযান শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর আবার পুরনো চেহারায় ফেরে এই এলাকা।

জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে এক যুগ আগে হাই কোর্ট আদেশ দিলেও তা প্রতিপালনের কোনো নামগন্ধই নেই। এ বিষয়ে প্রতি মাসে ট্রাফিক পুলিশের একটি দলকে ওই রায় বাস্তবায়ন বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে এ প্রতিবেদন দেওয়া হয় দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

সরেজমিন দেখা গেছে, জিরো পয়েন্টের পর পীর ইয়ামেনী মার্কেট এলাকা থেকে ফুটপাত ও সড়কে হকাররা নির্বিঘ্নেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন। একই অবস্থা গোলাপশাহ মাজার, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে নর্থসাউথ রোডের শুরু পর্যন্ত। কোথাও কোথাও রাস্তার অর্ধেকই দখল করে নিয়েছেন হকাররা। এরপর সিদ্দিকবাজার, আলুবাজার, সুরিটোলা, নয়াবাজার, মালিটোলা হয়ে রায়সাহেব বাজার পর্যন্ত সড়কের পাশের দোকানগুলোর মালপত্র, মাল ওঠানো-নামানোর গাড়িও দিনের বেশিরভাগ সময়ই সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখে।

রায়সাহেব বাজার থেকে সদরঘাট যেতে জনসন রোডের দুই পাশে ঢাকা জজ কোর্ট এলাকায় ফুটপাত ও সড়কে বেশ কয়েকটি স্থানে নিয়মিত হকাররা বসছেন। আদালতপাড়া পার হয়ে সদরঘাট বাস স্ট্যান্ড, যেখানে রয়েছে বাহাদুর শাহ পার্ক। এরপর সড়ক চলে গেছে বাংলাবাজার হয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। এই দীর্ঘ এলাকায় সড়কের দুই পাশ থেকে হকার উচ্ছেদে হাই কোর্ট আদেশ দেয় ২০১২ সালে।

যানজটের ভোগান্তি দূর করতে এর প্রতিকার চেয়ে ২০১২ সালে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী ‘সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ এইচআরপিবি হাই কোর্টে একটি রিট করে। শুনানি শেষে আদালত জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষকে। পাশাপাশি ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি পার্কিং বন্ধ, রাস্তার পাশের ফুটপাত বা রাস্তায় দোকানের পণ্য রাখা বন্ধ, রাস্তা-ফুটপাতে যেন ফেরিওয়ালা ও ফলের দোকান বসতে না পারে, সেজন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয় আদেশে।

ফলে ঢাকা মহানগরীর প্রায় সব ফুটপাত দিয়ে এখন আর পথচারীদের হাঁটার জো নেই। বেদখলে চলে গেছে বেশির ভাগ ফুটপাত। কোথাও সারি সারি দোকান, কোথাও নানা ধরনের নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, কোথাওবা পরিত্যক্ত যানবাহন। এখানে-সেখানে হুটহাট উঠে যায় মোটরসাইকেল, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো ফুটপাতে দেখা যায় প্রাইভেট কারও।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন সব চিত্র। যেসব ফুটপাত দোকানিদের দখলে থাকে নিয়মিত, সেই এলাকায় রীতিমতো চলে চাঁদাবাজি, মাসোহারা। এমনি বিশেষ কায়দায় ইজারা দেওয়ার ঘটনাও আছে। এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। এসব চাঁদা আদায়ে স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে প্রশাসনের প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধেও।

রাজধানীর নিউ মার্কেট ও বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাতে চলাচল কেবলই ক্রেতা আর বিক্রেতার। কারণ এই দুই এলাকার ফুটপাতে সাধারণ পথচারীদের হাঁটাচলা করার সুযোগ নেই। সবই বেদখল দোকানে। প্রায় সাত হাজারের মতো দোকান রয়েছে। এর মধ্যে বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাতে রয়েছে আড়াই হাজারের মতো।

অভিযোগ রয়েছে, এসব দোকান থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক নেতা, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা ও হকার্স নেতারা চাঁদা আদায় করছেন। থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের কিছু সদস্য এই এলাকায় নিজস্ব নির্দিষ্ট কিছু লোকের মাধ্যমে চাঁদাবাজির করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিউ মার্কেট এলাকায় প্রায় ২০০ জন লাইনম্যান এসব চাঁদার টাকা তোলেন। আর বায়তুল মোকাররমের ফুটপাত থেকে ১৫০ জনের মতো লাইনম্যান প্রতিদিন চাঁদা তুলে পৃষ্ঠপোষকদের মাঝে ভাগবণ্টন করে দেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিউ মার্কেট থেকে চাঁদা নেওয়ার শীর্ষে রয়েছেন: ফরমান, সাত্তার মোল্লা চাঁদপুরী, ইবু, বিপ্লব সরকার, নোয়াখাইল্লা সেলিম প্রমুখ। এরা নিউ মার্কেটের ফুটপাত ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের চাঁদার ভাগবণ্টন নিয়ন্ত্রণ করেন। এই দুটি এলাকায় তিন কিলোমিটার সড়ক ঘিরে জমে উঠেছে ফুটপাতের ব্যবসা। এসব রাস্তা স্থানীয় নেতা ও পুলিশের ভাগ করে দেওয়া। দুই শিফটে দুজন করে ব্যবসা করেন। তবে কিছু জায়গায় এক শিফটে ব্যবসা চলে। সর্বনিম্ন ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত লাইন খরচ দিতে হয়।

সূত্রগুলো জানায়, নিউ মার্কেট ও বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাত, সড়ক এবং অলিগলির রাস্তা দখল করে অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে সেখান থেকে মাসের পর মাস চাঁদা নিচ্ছেন হকার শ্রমিক, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা। নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই এলাকার ফুটপাতের চাঁদার ভাগ চলে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়। বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা জানান, এসব এলাকার চাঁদার টাকা যায় বিশেষ গাড়িতে। গাড়ি এসে চাঁদার টাকা নিয়ে যায়।

নিউ মার্কেটে কথা হয় ফুটপাতের ব্যবসায়ী পলাশ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, শুধু লাইন খরচ দিয়েই ব্যবসা করা যায় না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পজিশন নিতে পুলিশ সদস্যদের নির্ধারণ করা ব্যক্তি এবং আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণকারীদের দিতে হয় বড় অঙ্কের টাকা। পজিশনের টাকা কম হলে সেই জায়গাটি আরেকজনকে দিয়ে দেওয়া হয়।

নিউ মার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী জুলহাস হোসেন জানান, নিউ মার্কেটে একটা চৌকি ভাড়া নিলেও তার বিল আসে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এই ব্যবসা কন্ট্রোল করেন আড়ালে থাকা নেতারা। তারা কখনো সামনে আসেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা করতে পারছি এটাই বড় কথা। কে টাকা নিল, সেটা দেখার বিষয় আমাদের না।’

আরেক ব্যবসায়ী মামুন জানান, নিউ মার্কেটের ফুটপাতের ব্যবসা তো সিটি করপোরেশন হালাল করে দিয়েছে। তারা এর জন্য ইজারা দেয়। এ ছাড়া মোটরসাইকেল রাখার জন্য সিটি করপোরেশনের নামে রিসিপ্ট দেওয়া হয়। এসব দেখে তো মনে হয় সিটি করপোরেশনও চাঁদার কোটি কোটি টাকার ভাগ পায়।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়; যা চলে যায় দখলবাজ সিন্ডিকেটের পকেটে। সরকারের কোষাগারে একটি পয়সাও যায় না। এই বাণিজ্য ঘিরে প্রায়ই খুন, হামলা, সংঘর্ষের ঘটনাও কম না।

বায়তুল মোকাররমের ২ নম্বর গেটে কথা হয় পথচারী ওসমান মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কারণে কখনো কখনো পুরো রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। চলাচল করতে কষ্ট হয়। অনেকে আবার মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন, যার কারণে ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা। রাজনৈতিক নেতা, একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় চলছে ফুটপাত ও রাস্তা ভাড়ার এই মহাবাণিজ্য। সেটা দেখার কেউ নেই।
বায়তুল মোকাররমের মেইন গেটে ফুটপাত, সড়ক ও ফ্লাইওভারের নিচের খালি জায়গায় ছোট চৌকি বসিয়ে ব্যবসা করছেন বাকের মোল্লা।

তিনি বলেন, ‘থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের সবাইকে দিতে হয় চাঁদার টাকা। টাকা না দিলে কি চৌকি বসানো যায়? আমি এখানেই আট বছর ধরে ব্যবসা করছি। কোনো সমস্যা হয়নি। আপনি এসব জানতে চাইছেন কেন? আর ছবিই বা তুললেন কেন? আপনি মিয়া লোক ভালো না। এই বলেই মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিতে চান তিনি। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে বিষয়টি সমাধান করে দেয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এখানকার ফুটপাতের চাঁদার টাকা যায় বিশেষ গাড়িতে। সেই গাড়ি এসেই চাঁদার টাকা নিয়ে যায়। সেই সঙ্গে আলাদাভাবে টাকা দিতে হয়। এই চিত্র শুধু গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম এলাকার নয়। ঢাকার প্রায় সব এলাকাতেই একই চিত্র বিরাজমান।