আলমগীর হোসেন ও আবদুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১৩ সালে দ্য ফারমার্স ব্যাংক নামে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটির চরম দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ ব্যাংকপাড়ায় পুরাতন। ব্যাংকটির লাগামহীন অনিয়মের ফলে এর নাম পাল্টে ফেলতে হয়। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ফারমার্স ব্যাংকের নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক নামকরণ করা হয়।

পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে আসা হয় পরিবর্তন। এরপরও সেভাবে ভালো করতে পারেনি ব্যাংকটি। বড় বিদেশি বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েও তা নিয়ে আসতে না পারার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বাড়াসহ বিভিন্ন সমস্যার মুখে পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। ওই অবস্থায় ২০২০ সালে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তারা। আরেকটি প্রস্তাবে জোগান দেওয়া মূলধনের বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমপরিমাণ শেয়ার ইস্যু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

পরে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে যে চিঠি দেয়, সেখানে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।

তবে সব জল্পনা কল্পনার পর গুঞ্জন ওঠে মার্জার বা একীভূতকরণের। এরপর এই গুঞ্জন বাস্তবে রূপ নেয়। গত সোমবার শরীয়াহ্ভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে ব্যাংক দুটির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ফলে এখন থেকে এক্সিম ব্যাংক নামে চলবে পদ্মা ব্যাংকের সকল কার্যক্রম। একীভূত হবার পর পদ্মা নামে আর কোনো ব্যাংক থাকবে না। গত ১৪ মার্চ সকালে ব্যাংকের পর্ষদ সভায় পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডকে অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এক্সিম ব্যাংক।

তবে একীভূত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আতঙ্ক বেড়েছে আমানতকারীদের। যার প্রভাবে পদ্মা ব্যাংকে টাকা তোলার হিড়িক শুরু হয়েছে। চুক্তি সই হওয়ার দিন ও পরদিন ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় ভিড় করছেন আমানতকারীরা। তবে স্বল্প আমানতকারীদের টাকা দিয়ে দিলেও বড় গ্রাহকদের অর্থ দিতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় নিচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।

এদিকে শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক ও ধুঁকতে থাকা পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণ বাস্তবায়নে ১৮ মাস থেকে আড়াই বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন ব্যাংকগুলোকে নথিপত্রের সঙ্গে একীভূতকরণ স্কিমের কপিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকে আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে হবে।

নথিগুলোর মধ্যে দুই ব্যাংকের সম্পত্তির দাম, সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাবও দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খসড়া প্রকল্পে সন্তুষ্ট হলে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী একীভূতকরণের অনুমোদন দেবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা তৈরি করছে। ২০০৭ সাল থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতকরণের নীতিমালা থাকলেও তা বর্তমান সময়ের জন্য হালনাগাদ করা প্রয়োজন। শিগগিরই হালনাগাদ নীতিমালা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘খসড়া স্কিম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সম্পদ ও দায় মূল্যায়নের জন্য ব্যাংকগুলোয় নিরীক্ষক নিয়োগ দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’ ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের ক্ষেত্রে আইনি অনুমোদনের প্রয়োজন। সেগুলো পাওয়া গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে।

এক্সিম ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমোদনেরও প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালায় বলা হয়েছে সম্পদ মূল্যায়নে উভয় ব্যাংককে একমত হতে হবে। যদি তারা চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক মধ্যস্থতাকারী হয়ে মতপার্থক্য দূর করতে সহায়তা করবে।

সম্পদ ও দায়-দেনার মূল্যায়নে একমত না হলে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাতিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। একীভূত করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পেলে দুটি ব্যাংককে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ এর আওতায় অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলতে হবে। তাদেরকে হাইকোর্টে আবেদন করতে হবে ও একীভূতকরণের প্রকল্প জমা দিতে হবে।

হাইকোর্টে অনুমোদনের পর দুই ব্যাংকের একীভূতকরণের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। একীভূত হওয়ার পর তখন পদ্মা ব্যাংকের সম্পদ ও দায় এক্সিম ব্যাংকের সম্পদ ও দায় হিসেবে বিবেচিত হবে।

এদিকে একীভূত কার্যক্রম শুরুর পর গত মঙ্গলবার ছিল প্রথম কার্যদিবস। রাজধানীর মতিঝিল শাখায় সরেজমিন দেখা গেছে, সকাল থেকেই গ্রাহকদের আনাগোনা ছিল বেশ। স্বাভাবিক দিনের থেকে আমানতকারীদের ভিড় কিছুটা বেশি ছিল। স্বল্প অঙ্কের টাকা তাৎক্ষণিক দেওয়া হলেও বড় অঙ্কের জন্য সময় নিচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তারা।

টাকা তুলতে আসা শিমুল দম্পতি বলেন, আমাদের অল্প টাকা ছিল। সেগুলো তুলতে এসেছি। চেক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টাকা দিয়ে দিয়েছে। একই সময়ে আরেক গ্রাহক বলেন, পাঁচ লাখ টাকা তোলার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু আমাকে দুদিন পরে আসতে বলেছে। শুধু টাকা তুলতেই নয়, অনেকেই আসছেন খোঁজখবর নিতে। কাঞ্চন নামের এক গ্রাহক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি।

মার্জারের খবর শোনার পরে খোঁজ নিতে এসেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন কোনো সমস্যা হবে না। আরেক আমানতকারী বলেন, আমার আমানত ম্যাচিউর হয়েছে। কিন্তু আজকে টাকা দেয়নি। সপ্তাহখানেক পরে আসতে বলেছে। আরেক গ্রাহক বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে আতঙ্ক তো কিছুটা থাকবেই। তবে যেহেতু এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে তাই সমস্যা নাও হতে পারে। এখন দেখা যাক কী হয়।

এদিকে হঠাৎ করেই টাকা তুলতে আসা আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে কর্মকর্তাদের ওপর। তারা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে মতিঝিল শাখাপ্রধান মনির হোসাইন বলেন, স্বাভাবিকের তুলনায় আমাদের টাকা তোলার চাপ অনেক বেড়েছে। অনেকে ডিপোজিট ম্যাচুরিটি আসার আগেই টাকা তুলতে চাচ্ছেন।

মানুষের মাঝে একটা আতঙ্ক কাজ করছে টাকা দেবে কি না বা পাবে কি না। এটা স্বাভাবিক। আমরা গ্রাহকদের বোঝাচ্ছি। অনেকে বুঝছে। অনেকে বুঝতে চাইছে না। তাদের টাকা দিয়ে দিচ্ছি। শুধু মতিঝিলই নয়। রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি শাখায় খোঁজ নিয়ে একই অবস্থার কথা জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খান বলেন, এ ধরনের মার্জার প্রক্রিয়া দেশে আগে হয়নি। তাই অনেকেই টাকা তুলে নিচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এক্সিম ব্যাংক অনেক শক্তিশালী। সুতরাং আমানতকারীদের ঝুঁকিতে পড়ার কোনো সম্ভবনা নেই।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকার কারণে অনেক বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু এক্সিম ব্যাংকে আমানতে মুনাফা কিছুটা কম। এজন্য অনেকেই টাকা তুলে নিতে পারেন। তবে যাদের মেয়াদি আমানত রয়েছে, তাদের সুদের হার পরিবর্তনের কোনো সম্ভবনা নেই। তাই এখনই আমানত তুলে নেওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

উল্লেখ্য, দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন, অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করে। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা।

ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি একেএম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এখন এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী।

গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। এটি ইসলামী ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এরই মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত করতে পরিচালক পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশ করেছে ব্যাংকটি।