দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচিতে নেই বিএনপি। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ প্রশ্ন তুললেও তা দৃশ্যত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য নতুন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে পরিবর্তন না এনে আন্দোলনে গেলে আবারো ব্যর্থ হতে হবে। ফলে আন্দোলনকে নতুনভাবে সংগঠিত করার জন্য স্থায়ী কমিটিসহ দায়িত্বশীল বিভিন্ন পদে পুনর্গঠনের চাপ বাড়ছে।

তবে সরকারবিরোধী আন্দোলন সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি। এজন্য নিস্কিয়দের সরিয়ে সক্রিয় নেতাকর্মীদের দিয়ে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া গত মঙ্গলবার বিএনপিতে তিন নেতাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য থেকে একজনকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে। একজনকে গণশিক্ষা সম্পাদক থেকে বিভাগীয় সম্পাদক, এছাড়া অন্যজনকে সহ-সম্পাদক থেকে সম্পাদকীয় পদ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। দলের বিভিন্ন পদে আসছে বড় রদবদল। কোনো কারণে কাউন্সিল না হলেও শূন্য পদগুলো পূর্ণ করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। মহাসচিব পদ থেকে মির্জা ফখরুলকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে।

বিএনপি নেতারা জানান, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে অবস্থান করছেন। এ মুহূর্তে কোনো কারণে কাউন্সিল করা সম্ভব না হলেও শূন্য পদগুলো পূর্ণ করা হবে। দলের মূল নেতৃত্ব জিয়া পরিবারের মধ্যেই থাকবে। জানা গেছে, বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় নির্বাহী কমিটির ষষ্ঠ কাউন্সিল হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ।

দলটির গঠনতন্ত্রে বলা আছে  জাতীয় কাউন্সিলে তিন বছরের জন্য দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচিত হবে। কিন্তু তিন বছরের কমিটিতে আট বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে হয়নি একটি কাউন্সিলও। যদিও দলের নেতাদের দাবি- সরকারের দমন-পীড়নের কারণে কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি। ‘গুঞ্জন’ রয়েছে বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ব্যর্থতার দায়ে বিএনপি মহাসচিবের পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফলে বিকল্প মহাসচিব কে হবেন এ নিয়ে দলে আলোচনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গেও অনলাইনে পরামর্শ নিয়েছেন তারেক রহমান।

সূত্র জানায়, বিএনপির অস্থায়ী মহাসচিব হিসেবে দলের সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদকেও নিয়ে আসার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি ২২ বছর স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। জিয়াউর রহমান কিংবা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কখনো বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি।

প্রধানমন্ত্রী বানানোর প্রস্তাবসহ অন্তত চারবার বিশেষ প্রস্তাব পাওয়ার পরও জিয়া পরিবারের সঙ্গে বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নেননি। কূটনৈতিক ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যই তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মহাসচিব পদে এগিয়ে রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আগামী দিনে আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এজন্যই তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

এছাড়া মহাসচিব পদে আলোচনায় রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। যদিও তিনি ১০ বছর ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। কিন্তু তিনি জিয়া পরিবারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ১৯ জন। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এর পর ২০১৯ সালে বেগম সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ পর্যন্ত মৃত্যু এবং অবসর জনিত কারনে পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে।

সেই হিসাবে এখন সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। এদিকে কারাবন্দি ও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পাঁচ বছর ধরে রাজনীতি থেকে দূরে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সাময়িক মুক্তি পেলেও দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছেন না তিনি। শারীরিকভাবে অসুস্থতার কারণে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এছাড়া স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন।

তার পারিবারিক সূত্র বলছে, চিকিৎসকদের ভাষ্য তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে রাজপথের কর্মসূচিগুলোতে ফেরা অনেকটা অনিশ্চিত। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া অন্যের সহযোগিতা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কখনোই থাকেন না তিনি। নব্বই-ঊর্ধ্ব জমির উদ্দিন সরকার সব সময় বৈঠকে থাকেন না। বার্ধক্যজনিত কারণে এখন তিনি অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন।

বিভিন্ন সময় নানা কর্মকাণ্ডে দলের মধ্যে বারবার বিতর্কিত হয়েছেন তিনি। তাই স্থায়ী কমিটির পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়েও শঙ্কা রয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ মামলার কারণে ভারতে অবস্থান করছেন। তবে তিনি অনলাইনে বৈঠকগুলোতে যুক্ত থাকছেন। সক্রিয়দের মধ্যে কেবল মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান ও বেগম সেলিমা রহমান রয়েছেন।

দেশের বাইরে রয়েছেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিতি কখনোই ৮ থেকে ১০ জনের বেশি সদস্য থাকেন না। কমিটিতে থাকলেও বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে কয়েকজন নেতাকে কখনো বৈঠকে পাওয়া যায় না।
সূত্র জানায়, বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, রফিকুল ইসলাম মিয়া ও জমির উদ্দিন

সরকারকে স্থায়ী কমিটির পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হবে। এদিকে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় রয়েছেন যারা: দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মোহম্মদ শাহজাহান, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী,

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ার, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিমকোর্টে আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্থায়ী কমিটিতে যুক্ত হচ্ছেন বলে আলোচনায় রয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দলের পুনর্গঠন কাজ চলমান। যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থান করছেন এ সময় কাউন্সিল হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। কাউন্সিল না হলেও দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শূন্য পদগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যেই পূর্ণ করা হবে।  বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, মৃত্যু ও অসুস্থতাজনিত কারণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকটি পদ খালি রয়েছে। এগুলো পূরণ করা হবে বলে বলে জানতে পেরেছি।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারের দমন-পীড়ন মামলা হামলাসহ পারিপার্শ্বিকতার কারণে দীর্ঘদিন ও আমাদের কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি। এখন কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মৃত্যু এবং অসুস্থজনিত কারণে দলের যেসব পদগুলো শূন্য রয়েছে তা পূর্ণ করা হবে। এছাড়া দলের অঙ্গ সংগঠনগুলো পুনর্বিন্যাস চলছে।

দলের মহাসচিব পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন এই খবরে ভিত্তি কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এটা একটা গসিপ। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ খবর ছড়িয়েছে। মহাসচিব দেশে নেই দেশে আসুক। তাহলে এটা পরিষ্কার হবে। ১০১৬ সালে কাউন্সিল হওয়ার পর ১৯টি স্থায়ী কমিটির মধ্যে এখন পাঁচটি পদ শূন্য রয়েছে। ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে অন্তত ৯টি পদ ফাঁকা।

এ ছাড়া ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির মধ্যেও বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যেও কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। কয়েকজনকে বহিষ্কার আর কয়েকজন স্বেচ্ছায়ও পদত্যাগ করেছেন। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩০টির মতো পদ এখন শূন্য। তা ছাড়া বয়সের কারণেও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিস্কিয় রয়েছেন। যেই পদগুলো ফাঁকা রয়েছে তা পূর্ণ করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।