মনির হোসেন ও শফিকুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহলের আগ্রহের কারণেই দলটির এমন অবস্থান। সেইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হওয়া দলীয় কোন্দল আরও ঘনীভূত হতে পারে এমন শঙ্কায় দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এর পরও উপজেলা নির্বাচন ঘিরে কোনো পক্ষ যেন দলের নাম ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পারে, সেজন্য কঠোর নজরদারি করবে ক্ষমতাসীনরা। পুরোনো দ্বন্দ্ব ঘিরে কেউ নতুন করে সংঘাতে জড়ালে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে।

তবে উপজেলা নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দলের ভেতরে এই নীতির বিরোধী মত তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ‘নৌকা’ প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার পক্ষে সরব হচ্ছেন। একাধিক প্রার্থীকে ঘিরে বিভক্তি ও বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পেতে বড় অংশই একক প্রার্থী দেওয়ার পক্ষে।

কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই চান দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়া হোক। এমনকি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরাও এখন দলীয় মনোনয়ন প্রথা বহাল রাখতে চাইছেন। তবে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত দেওয়ায় বেশিরভাগ নেতাই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি নন।

তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দলীয় প্রতীক দেওয়ার দাবি অব্যাহত রেখেছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। গত শনিবার ও গত রোববার রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের নেতা, দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বৈঠকেও এই দাবি ফের উত্থাপন করা হয়েছে। প্রতীক না থাকলেও অন্তত দলীয় সমর্থন দিতে চান সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলার নেতারা। যদিও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এ ধরনের অতি উৎসাহী দাবি কেউ করেনি। তবে কোনো কোনো মহলে পর্যালোচনা হয়। তবে দলের কোনো কোনো নেতা কোনো কোনো জায়গায় নিজস্ব বলয়, আত্মীয়স্বজন প্রীতি থেকে নিজের সন্তান, শ্যালক, ভাই, স্ত্রী, ভাগনেদের জন্য প্রভাব বিস্তার করতে চান। দলীয়প্রধানের সিদ্ধান্ত দলের নেতাকর্মীরা সানন্দে গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বদ্ধ পরিকর। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে।’

জানা গেছে, দলের তৃণমূলের নেতাদের মতে, প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হলে দলের বিভেদ আরও বাড়বে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা যেহেতু প্রার্থী হবেন, সেক্ষেত্রে দলের নেতাকর্মীরা বিভাজিত হয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাবেন, যা বিভেদের দেয়াল আরও সুসংহত করবে। এ ছাড়া দলের

একাধিক প্রার্থীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর প্রার্থীর জয়ীর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, ফলের স্থানীয় সরকারের আওয়ামী লীগের আধিপত্যে ভাটা পড়বে। উপজেলায় আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে।

তবে দলীয় প্রতীক না থাকায় উপজেলা নির্বাচনে সংঘাত বাড়তে পারে, এমনকি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হতে পারে। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রেশ এখনো কাটেনি। এরই মধ্যে চলে আসছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ফলে এই নির্বাচনেও দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি প্রাণহানির ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। দলীয় প্রার্থী না থাকায় প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ফলে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত আরও বৃদ্ধি পাবে বলে দলের নেতাকর্মীদের আশঙ্কা।

এদিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে হলে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈতরণি পার হতে হয়। সেজন্য তৃণমূল আওয়ামী লীগের পাঠানো তালিকায়, বিভিন্ন জরিপ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে যাচাই-বাছাই করে দল প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। এসব ক্ষেত্রে অনেকে অস্বচ্ছ ও অসাধু প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। বিভিন্ন সময়ে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। এই চক্রের অনেকে দলীয় মনোনয়নের পক্ষে নীরবে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন প্রতীক ছাড়া হলে নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য অঙ্গের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু করবে। জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নেবে। দলীয় সভাপতির প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নেবে। জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে মনোমালিন্য ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রশমন করতে দল অত্যন্ত কঠোর।’