আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গুলশান-১-এর লেকপাড় থেকে ১৩০ নম্বর সড়ক ধরে কয়েক কদম হাঁটলেই ১২৬ নম্বর সড়ক। দুই সড়কের সীমানায় গড়ে ওঠা সুউচ্চ ভবনটিই পুলিশের সদ্য সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বাড়ি। চারপাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো কয়েকটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয় আশপাশ। ভেতরে ছোট ছোট দুটি কক্ষে নিরাপত্তারক্ষীদের অবস্থান। দুই দুয়ারি এই ভবনের বাইরে ফুটপাতঘেঁষা কাচে ঘেরা ফুলবাগান।

ফুলবাগানের আড়ালে বাড়ির নামফলকে লেখা সড়ক ও বাড়ির নম্বরসহ পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা। এই ঠিকানায় গত ২৮ মে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনজীর আহমেদকে ৬ জুন এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের আগামী ৯ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

চিঠি যখন এই বাড়িতে এসে পৌঁছায়, তার আগেই সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়েছেন। তাই দুদকের চিঠি তাঁদের হাতে পৌঁছায়নি, পড়ে আছে আলিশান এই ভবনের অভ্যর্থনাকক্ষে। এই বাড়িতেই থাকতেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। বেনজীরকে ৬ জুন ও স্ত্রী-সন্তানদের ৯ জুন দুদকে তলব করছে। তবে পরিবারের কেউ এখন এই বাড়িতে না থাকায় তাঁদের পক্ষে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। কথা হয় বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী রাকিবের সঙ্গে।

মিলেনিয়াম সার্টিস সিকিউরিটি বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি এজেন্সিতে কাজ করা এই নিরাপত্তারক্ষী বলেন, তিন সপ্তাহ আগে তিনি (বেনজীর আহমেদ) এই বাড়ি থাইকা বাইর হয়া গেছেন। তারপরে আর আসেন নাই। কই আছেন জানি না। খবরে দেখছি, উনি নাকি বিদেশ গেছেন।
সূত্র মতে, গত ৪ মে সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

তবে তিনি কখন ও কীভাবে দেশ ছেড়েছেন তা নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তার দেশ ছাড়া ও অবস্থান নিয়ে তার ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে দুই রকমের তথ্য পাওয়া গেছে। একটি সূত্র বলছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করে গত ৪ মে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশ ছাড়েন বেনজীর।

সূত্রটি আরও জানায়, স্ত্রী জীশান মির্জার চিকিৎসাজনিত কারণে তারা সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বেনজীর, তার স্ত্রী জিসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাশিন রাইসা বিনতে বেনজীর দুবাইয়ে রয়েছেন। তবে তারা সেখানে কী কারণে গেছেন সেটি জানাতে পারেনি ওই সূত্র। পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে সিঙ্গাপুর গেছেন, তা পুলিশের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত। তবে কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলছেন না।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলেছে, দেশ ছেড়ে আগেই চলে গেছেন বেনজীর। সিঙ্গাপুর হয়ে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন দুবাইয়ে। সম্পদ জব্দে আদালতের আদেশ, দুদকের তলব এসব নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি অনেকটা লাপাত্তা বেনজীর আহমেদ। বেনজীরকে প্রকাশ্যে দেখা না যাওয়ায় তার অবস্থান নিয়ে শোনা যাচ্ছে নানা গুঞ্জন। বেনজীর এখন কোথায় সেটি নিশ্চিত করতে পারছেন না কেউ।

তবে বেনজীর যখন সপরিবারে সিঙ্গাপুর যান, তখন দুদক তাকে নোটিশ দেয়নি, তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা নেই। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটকায়নি, বরং সাবেক আইজিপি হওয়ায় অনেকটা সুবিধা নিয়েই ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন তিনি। আলোচনায় থাকা বেনজীর আহমেদ সিঙ্গাপুরেই অবস্থান করছেন, নাকি সেখান থেকে অন্য কোনো দেশে চলে গেছেন, তা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা। অসমর্থিত সূত্র বলছে, তিনি এরই মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে দুবাই চলে গেছেন। সেখানেই তিনি সপরিবারে থিতু হওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন।

বেনজীরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর তিনি দেশে যোগাযোগ রেখেছিলেন। গত ২৬ মে আদালত তার ও স্ত্রী সন্তানদের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেওয়ার পরও তিনি যোগাযোগ করেন ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে। সম্প্রতি তার সেই যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কাউকে ফোনো দেন না, হোয়াটসঅ্যাপে কল করলেও তিনি ধরেন না।

ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রটি জানায়, তিনি (বেনজীর) কি দুদকে হাজিরা দিয়ে তার সম্পত্তির স্বপক্ষে দলিলপত্র উপস্থাপন করবেন, নাকি তা এড়িয়ে বিদেশেই স্থায়ী হবেন তা জানতে ৬ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এমনও আলোচনা রয়েছে, আইনজীবীর মাধ্যমে স্ত্রীর অসুস্থতার কথা জানিয়ে সেদিন সময়ের আবেদন করতে পারেন। তা ছাড়া তার ঠিকানায় দুদকের নোটিশ গেলেও তিনি তখন উপস্থিত না থাকায় সেটি অবগত নন বলে পরে আইনি সুযোগও নিতে পারেন। বেনজীরকে ৬ জুন দুদকে হাজির থাকার জন্য বলা হলেও ৯ জুন তার স্ত্রী জিশান মির্জাসহ সন্তানদের হাজির হতে বলা হয় নোটিশে।

আদালত বেনজীরসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন। তবে সূত্র বলছে, এসব ঘটতে পারে বলে তিনি হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন। এজন্য ব্যাংকের অনেক ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআরসহ বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেন। তবে বিষয়টি অতি ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কাউকে বুঝতে দেননি।

বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ৬২১ বিঘা জমি, ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পায় দুদক। এরপর দুদক এসব সম্পদ জব্দ (ফ্রিজ) করার আবেদন করলে আদালত তা আমলে নেন।

বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় র্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন।

যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ। অবশ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২০২২ সালের আগস্টে তিনি জাতিসংঘের পুলিশপ্রধান সম্মেলনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। তবে সম্মেলনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার বাইরে ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও তিনি যেতে পারেননি।

চাকরি জীবনে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা স্মার্ট কথাবার্তা ও চলাফেরার জন্য সব সময়েই আলোচনায় ছিলেন। শুদ্ধাচার ও বাহিনীর পদকও পেয়েছেন বারবার। কিন্তু তার অঢেল সম্পত্তি ও দুর্নীতির চিত্র সামনে আসার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।