গ্রামীণফোনের ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা

দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত টেলিকমিউনিকেশন খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোন দীর্ঘ ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে দেশের শীর্ষ টেলিকমিউনিকেশন খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোন যে আয় করেছে তার ১২৩ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারের জন্য বরাদ্দ রেখেছে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে কোম্পানিটি চূড়ান্তভাবে ৩৩০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ৩৩ টাকা করে লভ্যাংশ দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
এর আগে অন্তর্র্বতী লভ্যাংশ হিসেবে ১৬০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ১৬ টাকা করে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল, যা ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে চূড়ান্তভাবে ১৭০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ১৭ টাকা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, যা কোম্পানিটির মোট আয়ের ১২৩ শতাংশ। কোম্পানিটির আর্থিক বিবরীতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষে গ্রামীণফোন আয়ের বিপরীতে যে লভ্যাংশ দিয়েছে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগের ২০২৩ সালে কোম্পানিটির আয়ের ৫১ শতাংশ, ২০২২ ও ২০২১ সালে ৯৯ শতাংশ করে, ২০২০ সালে আয়ের শতভাগ লভ্যাংশ হিসেবে দিয়েছিল বিনিয়োগকারীদের।
লভ্যাংশ সংক্রান্ত বিষয়ে এক বার্তায় গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান বলেন, আমরা সবাই জানি, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও জিডিপির ধারাবাহিক হ্রাসসহ বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে, যা ব্যবসার বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য চাপ তৈরি করেছে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব ও মুনাফা প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হলেও আমরা আশ্বস্ত করতে চাই যে, বিনিয়োগকারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রাপ্তি ও স্থিতিশীলতার দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।
শেয়ারহোল্ডারদের নির্ভরযোগ্য ও ধারাবাহিক রিটার্ন প্রদানের লক্ষ্যে কোম্পানির নীতি অনুসরণ করে আকর্ষণীয় লভ্যাংশ প্রদান অব্যাহত থাকবে, যা নিশ্চিত হবে একটি শক্তিশালী ব্যালেন্স শিটের মাধ্যমে। আমরা বিশ্বাস করি, এটি সাময়িক অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতির মধ্যেও কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি শক্তিশালী অবস্থানের প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থার বহিঃপ্রকাশ।
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামীণফোনের কৌশলগত পরিকল্পনায় প্রাধান্য পাচ্ছে সাসটেইনিবিলিটি, উদ্ভাবন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। সরবরাহ ব্যবস্থাপানার সব পর্যায়ে আমরা সাসটেইনিবিলিটির দিকে নজর দিচ্ছি, যাতে সার্বিক মান নিশ্চিত হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের সাপ্লাইয়েরদের প্রদান করা অর্থের ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সেসব কোম্পানিতে যারা কার্বন নিঃসরণ কমাতে সংকল্পবদ্ধ।
সামনের দিনগুলোর জন্য উদ্ভাবনের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখাই আমাদের লক্ষ্য। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও গ্রাহক অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ করতে আমাদের বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে। আগামী বছরগুলোতে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আমাদের অগ্রগামী বিনিয়োগের সুফল দৃশ্যমান হবে। ফলে নিশ্চিত হবে স্বয়ংক্রিয় পরিচালন, স্বয়ংসম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা এবং আরও উন্নত গ্রাহকসেবা।
২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মোট ৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে গ্রামীণফোন লিমিটেড, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ কম। চতুর্থ প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির মোট গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৪৩ লাখে। গ্রামীণফোনের মোট গ্রাহকের ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ, অর্থাৎ ৪ কোটি ৮০ লাখ গ্রাহক ইন্টারনেটসেবা ব্যবহার করছেন। ২০২৪ শেষে গ্রামীণফোনের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২৬ টাকা ৮৯ পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ২৪ টাকা ৪৯ পয়সা।
একই বার্তায় গ্রামীণফোনের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার অটো রিসব্যাক বলেছেন, ‘পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর আমাদের মোট রাজস্ব ৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সাবস্ক্রিপশন ও ট্রাফিক খাতে রাজস্ব ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। মূলত, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডেটা ব্যবহারে গ্রাহকদের অতিরিক্ত সতর্কতার ফলে এমনটি ঘটেছে। আমরা আশাবাদী যে অর্থনীতি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরলে এবং মোবাইল হ্যান্ডসেট ও ডেটা ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে আমাদের রাজস্বও ধীরে ধীরে বাড়বে।
দক্ষ পরিচালন ব্যবস্থা এবং সঠিকভাবে মূলধন বরাদ্দের ফলে ২০২৪ সালে আমাদের ইবিআইটিডিএর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৩ কোটি টাকায় এবং ইবিটিডিএ মার্জিনের পরিমাণ ৬০ শতাংশের বেশি। মূলত, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকের এককালীন প্রভাবের কারণে কর-পরবর্তী মোট মুনাফার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, শক্তিশালী ব্যালেন্স শিটের কারণে এ বছরের মতো চ্যালেঞ্জিং অর্থনীতির মধ্যেও আমরা দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করতে পারছি। পাশাপাশি এটি একটি আকর্ষণীয় ও অনুমানযোগ্য লভ্যাংশ নীতির ভিত্তিও তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের জন্য শেয়ারপ্রতি ১৭ টাকা চূড়ান্ত লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে বোর্ড। এর আগে দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে শেয়ারপ্রতি ১৬ টাকা লভ্যাংশ প্রদান করেছিলাম আমরা।
এর ফলে ২০২৪ সালে প্রদেয় মোট লভ্যাংশের পরিমাণ দাঁড়াল ৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা, যা কর-পরবর্তী মোট মুনাফার ১২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম টানা কয়েক দিন বৃদ্ধি পায়। আট দিনে কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য বাড়ে প্রায় ১৩০ টাকা বা ৫৩ শতাংশ। তাতে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম চলে যায় প্রায় তিন বছর আগের অবস্থানে।
১৯৯৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রামীণফোনের ওপর বিশেষ নিরীক্ষার পর কোম্পানিটির কাছ থেকে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বকেয়া দাবি করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। পরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের নির্দেশে গ্রামীণফোনকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থও পরিশোধ করতে হয়েছিল। গ্রামীণফোন মূলত নগদ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। ২০২৩ সালে ১২৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ২২০ শতাংশ, ২০২১ সালে ২৫০ শতাংশ ও ২০২০ সালে ২৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল গ্রামীণফোন।