হতাশা ও অজানা আতঙ্কে ডুবছে পুঁজিবাজার, নেই কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ

শহীদুল ইসলাম ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের বড় দরপতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। টানা দরপতনে বাজারের ভবিষ্যত নিয়ে দু:চিন্তায় বিনিয়োগকারীর। গত ছয় কার্যদিবস ধরে একটানা দরপতনে পুঁজিবাজার। বাজার ভাল হওয়ার মতে বিএসইসির কার্যক্রমে নেই দৃশ্যমান উন্নতি। ফলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে হতাশা আর অজানা আতঙ্ক ভর করছে। তাছাড়া পুঁজিবাজার যেন দীর্ঘদিন ধরেই এক রহস্যময় পতনের পথে হাঁটছে। বাজারের অবস্থা এমন জায়গায় ঠেকেছে যে মুনাফা তো দূরের কথা, পুঁজি টিকিয়ে রাখাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে যে আস্থাহীনতা বিরাজ করছে, তার উন্নতি তো দূরের কথা বরং চরম হতাশায় নিমজ্জিত দেশের অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাত। টানা দরপতনে পুঁজি হারিয়ে নিঃশেষ হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। গত ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর একে একে পদত্যাগ করেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা। অন্তবর্তী সরকার দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর ১৩ আগস্ট বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম মাসরুর রিয়াজকে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে তার বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ তুলে তার নিয়োগের বিরোধিতা করে বিভিন্ন মহল। পরে তিনি নিজেই যোগদানে অপরাগতা জানালে ১৮ আগস্ট নিয়োগ দেয়া হয় সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে। দ্বায়িত্ব নিয়েই পুঁজিবাজারের সুশাসন নিশ্চিত করা ও আস্থা ফেরানো তার প্রথম কাজ বলে জানান তিনি।
কিন্তু বিএসইসির নেতৃত্বে পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য সকল জায়গার মতো পুঁজিবাজারেও আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের ছোঁয়া লাগলেও পুঁজিবাজারে নেই দৃশ্যমান উন্নতি। বেশ কয়েকটি কোম্পানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় কমিশন। কিন্তু জরিমানার মধ্যেই সীমিত থাকে এই পদক্ষেপ। পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স ৩টি বিষয়ে সুপারিশ দিলেও সংস্কার কার্যক্রম কবে নাগাদ শেষ হবে তাও নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি কমিশন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর কার্যত অভিভাবকহীন ছিল বিএসইসি। এসময়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল পুঁজিবাজার।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে গিয়েছিল। লেনদেনও বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল। কিন্তু গত বছরের ১৯ আগস্ট খন্দকার রাশেদ মাকসুদ যোগদানের পর থেকে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৭৭৫ পয়েন্ট থেকে প্রায় ৭০০ পয়েন্ট কমে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ৫০৪৪ পয়েন্টে। লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা থেকে নেমে আসে তিনশত কোটিতে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সব জায়গায় সংস্কার হলেও পুঁজিবাজারে নেই সংস্কারের ছোঁয়া। সংস্কারের ফলে ইতোমধ্যেই দেশের ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের বেহাল দশায় নেই দৃশ্যমান উন্নতি। বরং গত আট মাসে পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। আইপিও আসাও একেবারেই বন্ধ।
পুঁজিবাজারের এমন অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় পড়েছে বিএসইসির বর্তমান কমিশন। এরই মধ্যে নতুন করে বিএসইসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আস্থাহীনতায় পড়েছেন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। গত ৪ মার্চ নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগের দাবিতে বিএসইসিতে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
একাধিক বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন, এটা পুঁজিবাজার নয়, এটা মরন বাজার। এখানে বিনিয়োগ করলে লোকসান নিশ্চিত যেনে কেউ বিনিয়োগ করবে না। এছাড়া পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকতা নেই, নেই যথাযথ তদারকি। কারসাজির অভিযোগ বহুদিনের, কিন্তু কার্যকর প্রতিরোধের অভাবে এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। প্রতিরোধ যাও হচ্ছে, তাও ক্রমাগত বিতর্কের মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে কেবল নজরদারি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, বরং সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের বড় পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন সূচকের সাথে কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। তবে টাকার পরিমানে লেনদেন কিছুটা বেড়েছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এছাড়া দিনশেষে ডিএসই ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ২৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৪৪ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৮ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১২৬ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ৯ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৮৬৩ পয়েন্টে।
দিনভর লেনদেন হওয়া ৪০৬ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১০৩ টির, দর কমেছে ২৪৩ টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৬০ টির। ডিএসইতে ৩৫৯ কোটি ৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের কার্যদিবস থেকে ৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বেশি। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৩৫১ কোটি ৮ লাখ টাকার।
অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৬২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৩৫ পয়েন্টে। সিএসইতে ২১৪ টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৭ টির দর বেড়েছে, কমেছে ১১৪ টির এবং ৩৭ টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।