আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আর্থিক খাতে দুর্নীতি, লুটপাট ও অপশাসনের কারণে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার এই খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া বিগত সরকারের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির ফলে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পুনরায় গতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেছে।

সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও তা সরাসরি সম্প্রচার করছে।

এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অর্থ বিল অনুমোদন করে। সেইসঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদন করে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অন্যান্য উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব পাস হবে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।

বাজেট উপস্থাপনকালে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এই খাতকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে। ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলো বারবার পুনঃতফসিল করে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং চালু করায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুনে যেখানে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে অর্থাৎ মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

তিনি বলেন, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে সরকার শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তকরণ, বেসরকারি খাতের দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহ প্রদান, বাজারে কারসাজি রুখতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা এবং ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ বৃদ্ধি বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট প্রস্তাব করেছেন, যা জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার চিন্তা রয়েছে সরকারের।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সরকার আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ খসড়া করা হয়েছে, যা মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট ও সম্ভাব্য দেউলিয়াত্ব মোকাবিলায় সহায়ক হবে। এছাড়া তিনটি পৃথক টাস্কফোর্স গঠনের কথা জানান অর্থ উপদেষ্টা, যার কাজ হবে। ১. ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণগত পর্যালোচনা করা। ২. বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে নীতি ও প্রবিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। ৩. দেশি-বিদেশি চুরি বা পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।

অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেট দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানান সালেহউদ্দিন আহমেদ। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার হ্রাস পেলো।