পুঁজিবাজারে ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ১৯ ব্যাংকের মুনাফায় উল্লম্ফন
ষ্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষন, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে ১৯টির। গত বছর নগদ অর্থ সংকটে ছিল এমন সাতটি ব্যাংক তারল্য সংকট থেকে বেরিয়ে এসেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) আর্থিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছে ব্যাংকগুলো। নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭টি চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিয়ম অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জেও তা পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
পুঁজিবাজারে হঠাৎ লেনদেন বৃদ্ধির নেপথ্যে আইসিবি
ব্যাংকগুলোর পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে- ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া।
এর মধ্যে গত বছরের তুলনায় মুনাফার প্রবৃদ্ধিতে সবার ওপরে রয়েছে ওয়ান ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা গত বছরের তুলনায় বেড়ে প্রায় চারগুণ হয়েছে। শতকরা হিসাবে মুনাফা বেড়েছে ২৬১ শতাংশ। চলতি বছরের তিন মাসে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮৩ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ২৩ পয়সা। মুনাফায় বড় ধরনের উন্নতি হলেও ব্যাংকটির তারল্য অবস্থার অবনতি হয়েছে। অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১০ টাকা ৭৪ পয়সা। অথচ গত বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ছিল ২৬ পয়সা। ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়া মানে নগদ অর্থের সংকট দেখা দেয়া।
পুঁজিবাজারে ৩০ ব্যাংকের মধ্যে ১৯ ব্যাংকের মুনাফায় উল্লম্ফন
মুনাফার প্রবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়ে তিনগুণ ছাড়িয়েছে। শতকরা হিসাবে মুনাফা বেড়েছে ২৪৫ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১ পয়সা। মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও ব্যাংকটিরও তারল্য অবস্থার অবনতি হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৫ টাকা ৬৫ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ছিল ৩ টাকা ৯৬ পয়সা।
এনসিসি ব্যাংকের চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪০ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে ১১০ শতাংশ। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকটির তারল্য অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আগের বছর ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক থাকলেও চলতি বছরে পজিটিভ হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় মুনাফার প্রবৃদ্ধি ১০০ শতাংশের বেশি হওয়া ব্যাংকের তালিকায় আরও রয়েছে- ন্যাশনাল ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। আগের বছরের তুলনায় ১০৭ শতাংশ বেড়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৩১ পায়সা, যা আগের বছরে ছিল ১৫ পয়সা। যমুনা ব্যাংকের ১০৩ শতাংশ বেড়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৪২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭০ পয়সা।
ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরও অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক অবস্থায় আছে এমন ব্যাংক রয়েছে আরও চারটি। এর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। ঢাকা ব্যাংকের ৮ টাকা ৮৯ পয়সা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৫ টাকা ৪৮ পয়সা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৩ টাকা ৩৪ পয়সা এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩ টাকা ৪২ পয়সা শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক রয়েছে। এদিকে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পাশাপাশি পাঁচটি ব্যাংকের তারল্য অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আইএফআইসি, যমুনা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংক।
এছাড়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বরাবরের মতো লোকসানে রয়েছে। তবে ব্যাংকটির লোকসান আগের বছরের থেকে কমেছে। চলতি বছরের তিন মাসে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ পয়সা। এদিকে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের থেকে বাড়লেও ছয়টি ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে- এক্সিম ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও ইউসিবি।
ব্যাংকের মুনাফার চিত্র সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কোনো বিশেষ ব্যাংকের মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়-তো হতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফা বাড়া আপতত দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। এর পেছনে কী আছে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। কারণ বেশিরভাগ ব্যাংকের আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। খেলাপি ঋণের মাত্রও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে মুনাফা কেমন করে বড়ে? তবে কেউ কেউ পুনঃতফসিলি ঋণের বকেয়া সুদ ইনকাম অ্যাকাউন্টে নিয়ে যায়। মুনাফা বাড়ার পেছনে এটা একটা কারণ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, জানুয়ারি-মার্চে ব্যাংকগুলো ব্যবসা করতে পেরেছি। তারপরও সার্বিক যে পরিস্থিতি তাতে বেশিরভাগ ব্যাংকের মুনাফা বাড়ার কথা নয়। বরং আগের বছরের তুলনায় কমার কথা। গত বছরের তুলনায় ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।
এ বিষয় যোগাযোগ করা হলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে ব্যাংকগুলো মোটামুটি ভালো ব্যবসা করেছে। এ কারণেই মুনাফা বেড়েছে। তবে পরের প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ভালো ব্যবসা করা কঠিন। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ মুভ-ই করতে পারছে না। স্বাভাবিকভাবে আগামী প্রান্তিকে ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।