দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বহুল আলোচিত ঝিনাইদহের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার ‘হত্যাকাণ্ডের’ তদন্ত কার্যক্রম থমকে গেছে। কলকাতায় কথিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া আনার খুনের নানা চাঞ্চল্যকর বা চমকপ্রদ তথ্য জানানো হলেও বর্তমানে মামলাটি নিয়ে তেমন ভ্রুক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি তদন্ত শেষ করতে কিংবা আনার হত্যা বা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ‘ডিএনএ’ পরীক্ষার যে জরুরি প্রয়োজনীয়তা আছে, সেটিও রহস্যজনক কারণে সম্পন্ন হয়নি। আর এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন না হওয়ার জন্য মূলত সাবেক এমপি আনারের কন্যাসহ পরিবারের অসহযোগিতা-অনীহাকেই দায়ী করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বিভিন্ন সময় তার বাবার হত্যার বিচার চেয়ে বক্তব্য দেন।

কিন্তু বাবার মারা যাওয়ার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডরিনকে ডিএনএ আলামত দিতে বারবার কলাকাতায় ডাকা হলেও তিনি অজ্ঞাত কারণে সাড়া দেননি বলে অভিযোগ আছে। আনারের পরিবারের অসহযোগিতার কারণেই কাগজে কলমে আনারের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। কাগজে কলমে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহভাজন প্রধান আসামি আক্তারুজ্জামান শাহিনকে বিদেশ থেকে ফেরানোর পথও সুগম হচ্ছে না।

অন্যদিকে ভারতীয় পুলিশ ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য চিঠি পাঠিয়ে আনারের পরিবারের সদস্যদের সাড়া না পেয়ে ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই মামলার প্রাথমিক চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে। যেটা ভারতের আদালত গ্রহণও করেছেন। ভারতের তদন্ত সূত্রে জানা যায়, চার্জশিটে সিআইডির হাতে গ্রেফতার কসাই জিহাদ হাওলাদার এবং সিয়াম হোসেনের নাম আছে। তবে কী উদ্দেশে তাকে খুন করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহিনকে এখনও ধরা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে ঘটনার মোটিভ এখনও অজানা।

এসব কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার কি সত্যিই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন? নাকি তাকে আড়ালে রেখে অন্য কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে? তবে কলকাতার যে বাসায় হত্যার কথা গ্রেফতারকৃতরা শুরুর দিকে পুলিশকে বলেছিলেন সে বর্ণনাগুলো মেনে নিলে আনারের মৃত্যুর বিষয়টি সঠিক হিসেবেই ধরা যায়।

কিন্তু মরদেহ তো পাওয়া যায়নি। তা হলে মৃত্যুর বিষয়টি আদালতে আইনগত দিক থেকে কীভাবে প্রমাণিত হবে? তদন্ত নিয়ে যা বলছেন ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তারা: ভারতে আনার হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে গত ৮ সেপ্টেম্বর হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কথা হয়েছে সময়ের আলোর এই প্রতিবেদকের। যা অডিও রেকর্ড আকারে সংরক্ষিত আছে।

ওই কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডিএনএ ছাড়া শনাক্ত (আনারকে) করা কঠিন। খুন হাওয়ার পর প্রধান কাজ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা এবং সেটা আমাদের করতেই হবে। কিন্তু হচ্ছে না। কারণ আনারের পরিবার আসছে না। আমরা অফিসিয়ালি চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি। তারা আসবে বলেও আসছেন না। আগস্ট মাসের শেষের দিকেও ডরিনকে ভারতে আসার বিষয়ে বলা হয়েছিল, আসব আসব বলছে, কিন্তু আসছে না। অফিসিয়ালি আবার চিঠি দেওয়া হবে ডরিন ও তার পরিবারকে ডিএনএ দিতে ভারতে আসার জন্য।’

ভারতে তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের নিয়ম আছে ৯০ দিনের মধ্যে প্রাথমিক চার্জশিট দিতে হবে। না হলে আসামি জামিনে বের হয়ে যাবে। তাই গত ১৭ আগস্ট প্রাথমিক চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি। আদালত সেটা গ্রহণ করেছে এবং খুব তাড়াতাড়ি বিচারও শুরু করে দেবেন আদালত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তে পাওয়া তথ্য এবং আনারের পরিবারের ডিএনএ।

আসামিরা কারা কারা কলকাতায় এসেছিলেন এবং কী তথ্য পাওয়া গেছে সেসব জানতে আমরা বাংলাদেশের পুলিশের কাছে তথ্য চেয়েছিলাম। তারা জানাননি। বাংলাদেশের আসামিদের আইডেন্টিটি আমরা বুঝতে পারছি না। প্রাথমিকভাবে ভারতে গ্রেফতার দুজন জড়িত আছে। এ ছাড়া কারা জড়িত আছে তাদের বিষয়ে খোঁজ করছি। চলতি মাসের ১৩ তারিখে আবার একটা শুনানির তারিখ রয়েছে।’

যেভাবে চলছে বাংলাদেশ পুলিশের তদন্ত : আনার হত্যা মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. শাহিদুর রহমানকে বদলি করে তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবি ওয়ারী বিভাগের সহকারী উপকমিশনার (এসি) মাহফুজুর রহমানকে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এসি মাহফুজুর রহমানকে বদলি করে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিবি ওয়ারী জোনাল টিমের এডিসি ফজলুল করিমকে।

এ প্রসঙ্গে এডিসি ফজলুল করিম বলেন, ‘আনার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে সদ্য আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মামলাটা মাত্র আমার নামে সার্ভারে এন্ট্রি হয়েছে। এখনও কাজ শুরু করতে পারিনি। মামলাটি নিয়ে কাজ শুরু করি, পরে বিস্তারিত বলতে পারব।’

মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির এসি মাহফুজুর রহমান বলেন, মামলার প্রধান আসামি শাহিনকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে ডিবির পক্ষ থেকে আমেরিকার দূতাবাসে কথা বলা হয়েছিল। তবে আনারের হত্যা কাগজে কলমে প্রমাণ করতে হলে ডিএনএ মিলিয়ে প্রমাণ করতে হবে। আর এই প্রমাণ নিয়ে দূতাবাসে গেলে শাহিনকে ফেরানো সহজ হবে। সেফটিক ট্যাঙ্কে পাওয়া পচা মাংসের টুকরা ও হাড়ের টুকরা এনে দেশে ডিএনএ প্রোফাইলিং করা যেত কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আনঅফিসিয়ালি এনে লাভ নেই। আনতে হলে প্রপার চ্যানেলে আদালতের মাধ্যমে আনতে হবে।

কেন ভারতে যাচ্ছে না আনারের পরিবার: এমন তথ্য জানার জন্য আনারের কন্যা ডরিনকে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। আনারের পিএস আবদুর রউফ গত ৩১ জুলাই বলেছিলেন, আমরা কার কাছে যাব, কোথায় যাব, কী করব এসবকিছু তদারকির জন্য একটা ডিবির প্রতিনিধি টিম যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের জুলাই মাসেই যাওয়ার কথা ছিল। একে তো দেশের এই অবস্থা, তা ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ডিবির একজন প্রতিনিধির জিও করা লাগবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আমরা জিওর বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম। সেটা এখনও হয়নি।

ডিবি ডাকলেও আপনারা সাড়া দিচ্ছেন না- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরে তিনি বলেন, এ রকম বিষয় না। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে কেউ। সাড়া না দেওয়ার তো কিছু নেই। এদিকে গত ৮ সেপ্টেম্বরও ডরিনকে একাধিকবার ফোন করে সাড়া না পেয়ে আবদুর রউফকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমরা প্রস্তুত আছি ভারতে যাওয়ার জন্য। ডিবি থেকে জানালেই আমরা যাব।

যদিও ডিবি সূত্র বলছে, ভারত থেকে গত ১৬ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার হয়ে ঝিনাইদহের এসপি বরাবর চিঠি যায়। চিঠির একটা অনুলিপি পাঠানো হয় ডিবি বরাবর। চিঠিতে ডিএনএ দেওয়ার জন্য ডরিন, তার চাচা ও মাকে ভারতে যেতে বলা হয়েছে। তবে তারা সাড়া দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আনারের মৃত্যু হয়েছে হিসেবে তার শূন্য সংসদীয় আসনে মেয়ে ডরিনের উপনির্বাচন করার একটি পারিবারিক প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু ডরিনের বয়স ২৫ হতে এখনও কয়েক মাস বাকি। সে কারণেই হয়তো কাগজে কলমে মৃত্যু নিশ্চিতের বিষয়টি বিলম্বে প্রমাণের পরিকল্পনা থেকে কালক্ষেপণ করা হয়ে থাকতে পারে। যদিও গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুরো সংসদই ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

গণমাধ্যমে চাঞ্চল্যকর লোমহর্ষক বর্ণনা : গত মে মাসের বহুল আলোচিত এ ঘটনাটি প্রথম দিকে গণমাধ্যমে দিনের পর দিন ব্রিফিং করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে লোমহর্ষক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যার মূলে ছিলেন তৎকালীন ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। অনেকটা স্যুটিং করার মতো করে ‘খুনিদের’ বর্ণনাগুলো প্রচার করা হয়। তবে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ থাকে মরদেহ চিহ্নিত বা শনাক্ত করা।

আনারের মরদেহের যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে কাগজে কলমে এই মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি। গ্রেফতার আসামিদের নিয়ে ভারতের বেশ কয়কটি জায়গায় অভিযান চালিয়ে হাড় ও মাংসের কিছু পচা টুকরা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দাবি করা হয়, এগুলো আনারের মরদেহের অংশবিশেষ। প্রায় ৪ মাস হতে চললেও কাগজে কলমে এই মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

গুরুত্বপূর্ণ মামলা সত্ত্বেও সুপারভাইজিং কমিটি হয়নি : নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এর আগের দুই তদন্ত কর্মকর্তার এই আন্তঃদেশীয় মামলা প্রথমবারের মতো তদন্ত করেছেন। যে কারণে তাকে গাইড করার জন্য আমাদের দেশে পুলিশ হেডকোয়ার্টার কিংবা ডিএমপি থেকে উচ্চ পর্যায়ে সুপারভাইজিং বা মনিটরিং কমিটি গঠন করার প্রয়োজন ছিল। তবে কেন গঠন করা হলো না সেটাও স্পষ্ট না।

যার ফলে তদন্ত কর্মকর্তার অনেক বিষয় বুঝতে হিমশিম খেতে হয়েছে বা হচ্ছে। সুপারভাইজিং কমিটি নিয়মিত তদারকি করবে তদন্ত কর্মকর্তাকে এবং দিতে হবে গাইডলাইন।সুপারভাইজিং কিমিটির বিষয়টি আইনেই আছে। তিনি বলেন, ডরিন নিয়মিত বক্তব্যে বাবার বিচার চান। তবে আনার হত্যা প্রমাণে তাদের যা প্রয়োজন সেটা বাদে সব করছেন।

বিশেষজ্ঞ অভিমতে যা বলছেন ড. তৌহিদুল হক : আনার হত্যার এমন ধূম্রজাল প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ অভিমত জানতে চাইলে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, এপার বাংলা ওপার বাংলা থেকে আমরা নানা ধরনের তথ্য পেয়েছি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারাও নানা ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তবে ডিএনএ স্যাম্পেলিংয়ের মধ্য দিয়ে আইনিভাবে মৃত ব্যক্তিকে প্রকৃত শনাক্তকরণ করতে নিহতের পরিবারকে ইতিবাচক ও কার্যকর ভূমিকা রাখেন। পরিবার এ বিষয়ে সাহায্য না করলে তদন্ত দীর্ঘমেয়াদি হবে। দীর্ঘমেয়াদি হলে আলামত নষ্ট হবে। আর তারা ভারতে ডিএনএ দিতে না গেলে তখন মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগবে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক আরও বলেন, এটি একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ। দুই বাংলায়ই তদন্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুই দেশ বা আলাদা আলাদা একটা সুপারভাইজিং কমিটি করা যেতে পারত। আমার দেশের সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে এই বিষয়ে বাংলাদেশের বেশি আগ্রহ থাকতে হবে। শুধু একজন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দিলে তার পক্ষে এই মামলার কূলকিনারা খুঁজে বের করা কঠিন।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠেন এমপি আনার। পরদিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ১৮ মে তার পরিবারের সদস্যরা জানায়, তারা আনারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না।

পরে ২২ মে ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ জানায়, এমপি আনারকে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় ভারতে হয় হত্যা মামলা এবং বাংলাদেশে হয় অপহরণ মামলা। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল মিলিয়ে মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে ভারতের কারাগারে দুজন ও বাংলাদেশের কারাগারে সাতজন আসামি রয়েছেন। এই সাতজনের মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।