দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য বেশকিছু প্রণোদনা দেয়া হলেও টানা বড় দরপতন দেখা দিয়েছে। মূলত কোম্পানির রিজার্ভ ও বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর আরোপ করায় শেয়ারবাজারে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির নগদ লভ্যাংশ ও পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ জমা (রিজার্ভ) হলে তার ওপর করারোপ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

তরা বলছেন, রিজার্ভ ও বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর সংক্রান্ত যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে। রিজার্ভের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করায় কোম্পানির সম্প্রসারণে অসুবিধা হবে। আবার রিজার্ভ ভাঙার কারণে ভালো কোম্পানির মৌলভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। সুতরাং রিজার্ভের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এছাড়া বোনাস লভ্যাংশের ওপর কর আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাও সঠিক হয়নি। যে কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্জিত মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার দিলে তাতে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

একইসঙ্গে কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস বা বিভিন্ন ধরনের রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি থাকলে বর্ধিত অংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছে। এই কর আরোপ নিয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের দুই ধরনের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। একটি হল স্টক ডিভিডেন্ড বা বোনাস শেয়ার। অন্যটি হলো নগদ লভ্যাংশ বা ক্যাশ ডিভিডেন্ড । সাধারণত বিনিয়োগকারীরা বোনাস শেয়ারের পরিবর্তে নগদ লভ্যাংশ প্রত্যাশা করেন।

কিন্তু কোম্পানিগুলোর ছলছাতুরি করে নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার দেয়ার প্রবণতা বেশি। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে স্টক ডিভিডেন্ড এর পরিবর্তে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়াকে উৎসাহিত করতে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরিবর্তে রিটেইনড আর্নিংস বা বিভিন্ন রিজার্ভ হিসেবে মুনাফার টাকা রেখে দেওয়া হয়। এতে করে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হন এবং পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এই ধরণের প্রবণতা রোধে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ কোম্পানির পরিশোধিত মুলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হলে বর্ধিত অংশের ওপর কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। মূলত কোম্পানিগুলো যাতে রিজার্ভ বাড়ানোর নামে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দেওয়া থেকে বঞ্চিত না করে সেই কারণে এই কর আরোপ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো: রকিবুর রহমান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘আমাদের পুঁজিবাজারকে আমেরিকা কিংবা ভারতের পুঁজিবাজারের সাথে তুলনা করলে হবে না। কারণ আমাদের দেশে অধিকাংশ কোম্পানি নিয়ম কানুন মানে না। তারা নানা ছলছাতুরি করে কোম্পানির মুনাফা বিনিয়োগকারীদের দেয় না। কখনো রিজার্ভ বাড়ানোর নামে কিংবা বোনাস শেয়ার দিয়ে বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দেওয়া থেকে বঞ্চিত করে।

তিনি বলেন, ক্যাশ ডিভিডেন্ড উৎসাহিত করতে স্টক ডিভিডেন্ড বা বোনাস শেয়ারের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। এটা বাজেটে অর্থমন্ত্রী তা জেনে শুনেই করেছেন। অনেক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস শেয়ারের কাগজ ধরিয়ে দেন। পরবর্তীতে কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা শেয়ারের ইপিএস, রিজার্ভ বাড়িয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করে দেন। এতে করে কোম্পানির উদ্যেক্তারা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

রকিবুর রহমান বলেন, কেউ কেউ বলছেন তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভের ওপর করারোপের কারণে কোম্পানির সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। এটা সঠিক নয় কারণ অনেক কোম্পানি বছরের পর বছর মুনাফার টাকা শেয়ারহোল্ডাদের লভ্যাংশ না দিয়ে রিজার্ভ বাড়িয়েছে।

কিন্তু তারা কোম্পানি সম্প্রসারণে না গিয়ে কোম্পানিগুলো রিজার্ভ এবং রিটেইনড আর্নিংস বছরের পর ধরে রেখেছে। অথচ কোম্পানি সম্প্রসারণে গেলে শেয়ারহোল্ডাররা তার সুফল পেত। তাই, কোম্পানিগুলো যেন রিজার্ভের টাকা ধরে রাখতে না পারে সেজন্য ১৫ শতাংশ কর আরোপ যুক্তিসঙ্গত হয়েছে।

ডিএসইর চেয়ারম্যান প্রফেসর আবুল হাসেম বলেন, ‘কোম্পানিগুলো নগদ লভ্যাংশ না দিলে বিনিয়োগকারীরা চলবে কিভাবে। তাই, সাময়িকভাবে হলেও বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ক্যাশ ডিভিডেন্ড ও রিজার্ভের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ যথাযথ হয়েছে।

অন্যদিকে, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানির স্টক ডিভিডেন্ড এবং রিজার্ভের ওপর কর বসানো যুক্তিযুক্ত হয়নি। এটা যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে বসানো হয়নি। এটা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হবে।

ব্যাংকগুলো যদি স্টক ডিভিডেন্ড দিতে না পারে তাহলে তারা ব্যাসেল-৩ কিভাবে বাস্তবায়ন করবে। এছাড়াও, এই সিদ্ধান্তের কারণে বিদেশি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে না। বরং এটা না হলে অর্থমন্ত্রীর উচিত ছিল তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট কর ২ থেকে ৫ শতাংশ কমিয়ে আনা।

অন্যদিকে, ডিএসই পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্ত সাময়িক ভালো হলেও দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারের জন্য ক্ষতিকর। এই কারণে অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে চাইবে না। এতে করে কোম্পানির পুঁজিগঠন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি।’

উল্লেখ্য, বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৩১২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ২০৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভের পরিমাণ পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর আরোপের কারণে এই সব কোম্পানি থেকে সরকারের কর বাবদ আয় হবে প্রায় ১০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা।