বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার ইস্যূতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ এ প্রশ্ন এখন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীর মুখে মুখে। কারন দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন ধারাবাহিক পুঁজিবাজার পতনের কারন কি? তাছাড়া পুঁজিবাজার টানা দরপতন হলেও অর্থমন্ত্রী কি ভাবে স্থিতিশীল করা যায়, এ ব্যাপারে কোন সূদর ভূমিকা চোখে পড়ছে না।

যেখানে দেশের জিডিপিতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং পরের অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে এক বছরের মাথায় পুঁজিবাজারে প্রায় ২ হাজারের বেশি সূচকের অবনতির কারন কি? ২৮ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ লজ্জায় আর পুলিশের ভয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না।

তাছাড়া সরকারি অনুমানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেখা পাওয়া বাংলাদেশ এ অঞ্চলের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি। এ দেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে বলে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। তবে কেন ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিন্মমুখী।

এ প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ সহ পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের। তাছাড়া পুঁজিবাজার বাজার তথা দেশের পুরো অর্থনীতির দায়িত্বভার যার কাধেঁ, সেই অর্থমন্ত্রীর পুঁজিবাজার নিয়ে বৈঠক তথা বক্তব্যের পরেই পুঁজিবাজারে বড় দরপতন নিয়মিত হয়ে দাড়িঁয়েছে। তবে এই পতনের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের কোন সর্ম্পক্য নেই বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এটাকে কাকতালীয় মনে করেন তারা।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস শেয়ারবাজার উত্থানে থাকলেও এরপর থেকেই পতনে রয়েছে। যে পতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক বিগত সাড়ে ৩ বছর আগের অবস্থানে চলে গেছে। এমন পতনরোধে স্টেকহোল্ডাররা অর্থমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামালও তাতে সাড়াঁ দিয়েছেন এবং পুঁজিবাজার নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ বার বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু এই ৬ বারের মধ্যে পরবর্তী ৫ কার্যদিবসই পুঁজিবাজারে পতন হয়েছে। আর ১ কার্যদিবস উত্থান হয়েছে।

গত বছরের ২৮ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আয়োজিত ‘বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা কনফারেন্স ঢাকা-২০১৯’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেয়ারবাজার নিয়ে বক্তব্য রাখেন। এর পরের দিনই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক কমে ১৪ পয়েন্ট। এরপরে গত ২২ এপ্রিল চলমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বিএসইসির সঙ্গে এক জরুরী সভা করেন অর্থমন্ত্রী। এতে তিনি শেয়ারবাজার সঠিক অবস্থানে আছে বলে বক্তব্য রাখেন।

এর পরের দিন ডিএসইর সূচক কমে ৬৩ পয়েন্ট। এরপরে ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রণোদনা দেওয়া হবে বলে বিনিয়োগকারীদেরকে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু এরপরের দিনও সূচক কমে ৬৩ পয়েন্ট। গত ৩০ এপ্রিল প্রধান অতিথি হিসাবে ডিএসইর স্মল ক্যাপ মার্কেট বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) প্লাটফরম উদ্বোধনী করেন অর্থমন্ত্রী। ওইসময় শেয়ারবাজারের বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তবে ওইদিনের বক্তব্যের পরে ডিএসইর সূচক বাড়ে ৮৪ পয়েন্ট।

এরপরে গত ১৬ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী মতবিনিময় সভা করেন। সভা শেষে সাংবাদিকদের কাছে শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু এরপরের দিন ডিএসইর সূচক কমে ৩১ পয়েন্ট। এদিকে সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি বিকাল ৩টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বিএসইসি ও ডিএসইর সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। এতে তিনি শেয়ারবাজার নিয়ে ডিএসইর কিছু প্রস্তাব নেন।

এছাড়া লেনদেনে কর সুবিধা বাড়ানো, সরকারি কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনাসহ আরও কিছু বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। তবে ওই দিনের বক্তব্যের পরের কার্যদিবস (৫ জানুয়ারি) ডিএসইর সূচক কমেছে ৫৯ পয়েন্ট। এদিকে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আবু জাফর। ২০১০ সালে ৬৬ লাখ টাকা দিয়ে পুঁজিবাজারে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এখন তার বিনিয়োগ পাঁচ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। দেশের অর্থনীতি যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন পুঁজিবাজার নেমে যাচ্ছে।

তার প্রশ্ন, পুঁজিবাজার আর কবে ভালো হবে? আদৌ ভালো হবে কি? লাভ নয়, অন্তত তার বিনিয়োগকৃত টাকা ফিরে পাবেন কি না তারও কোনো জবাব নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কোনো মহলের কাছে। আবু জাফরের মতো দিশেহারা দেশের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। তাদের প্রশ্ন, এ পতনের আসলে শেষ কোথায়?

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে পুঁজিবাজারের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহলকে। খোদ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে যা কিছু করা দরকার এ সরকার তাই করবে। তারপরও কেন পুঁজিবাজারের এ বেহাল অবস্থা প্রশ্ন বিনিয়োগকারীদের।

তবে আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বলেছেন, পুঁজিবাজার কত নিচে যেতে পারে আমি দেখতে চাই। এটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। আপনারা নিজেদের এবং আমার উপর বিশ্বাস রাখবেন। দেশের অর্থনীতি যত বড় হবে, পুঁজিবাজারও তত বড় হবে। পুঁজিবাজারকে ঠেলে দিয়ে অর্থনীতির কথা চিন্তা করা যায় না। তাই পেছনের সব ভুল ভ্রুটি সমাধানের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। অর্থমন্ত্রীর এরকম বক্তব্যের পর প্রায় ২ হাজারের বেশি সূচকের পতন হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিনিয়ত শেয়ারের দর, সূচক, টার্নওভার কমে যাচ্ছে। বিশ্বের অর্থনীতি উন্নয়নের উদাহরণ হতে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে পুঁজিবাজারও বাড়ার কথা; কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

তাদের বক্তব্য, বাজার ভালো করতে হলে বিনিয়োগকারীর চাহিদা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ভালো মানের ইকুইটি আনতে হবে। নড়বড়ে কোম্পানি দিয়ে বাজার ভালো করা যাবে না। পতনের মৌলিক কারণ নির্দিষ্টকরণ করতে হবে। শেয়ারবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধসের জন্য মুষ্টিমেয় স্বার্থের প্রতাপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, পুঁজিবাজারের পুরোটাই হলো গুটিকয়েক লোকের হাতে কুক্ষিগত। গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে শতকরা ৮০ ভাগ বাজার মূলধন রয়েছে। পুরো বাজারে তাদের পুঁজিই ৮০ ভাগ। বড় লেনদেনের ৮০ ভাগও করেন তারাই। এ জন্য তারা নিজেদের অনুক‚লে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আবার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থের পরিমাণ খুবই কম। এর কারণে তারা মুষ্টিমেয় লোকের কাছে জিম্মি।

বাজারের ওঠানামায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বারবার বিএসইসি থেকে বলা হয়েছে, যারা বাজারে দখলিস্বত্ব কায়েম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কমিটি করা হলেও কোনো ব্যবস্থা কখনোই নেয়া হয়নি। এবারও দুই হাজার বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে খোঁজখবরের কথা বলা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন এত বেশি জিডিপির দেশে পুঁজিবাজার এত ছোটো হবে কেন?

পৃথিবীর সব পুঁজিবাজারেই সব ধরনের কোম্পানির তালিকাভুক্তির চেষ্টা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করা হয় না। করা হলে এটা সর্বজনের মুক্তবাজার হতে পারত। পরিণামে তথাকথিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে পুঁজিবাজারের আকারের মিল থাকত।