বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের স্বার্থে ৫টি মূলনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলেও সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি’) শেয়ারবাজারে ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে অনাকাক্ষিত ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকান্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশেষ করে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দায়িত্ব হলেও দীর্ঘ নয় বছরেরও অধিক সময় ধরে সংকট উত্তরণে আইসিবির দৃশত তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করলে পুঁজিবাজারের এ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনায়নে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। সে হিসেবে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করলে বাজার ইতিবাচক ধারায় অনেক আগেই ফিরত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ বিনিয়োগকারীর ভূমিকা পালন করছে। আইসিবি অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ করে প্রতি অর্থবছরেই রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। আইসিবি সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতো অতি মুনাফার আশা করে। তবে এবারে প্রতিষ্ঠানটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই প্রথমবারের মতো বাজার ভালো না হওয়ায় বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে আইসিবি। মুনাফার পরিবর্তে চলতি অর্থবছরের তিন মাসের হিসাবে লোকসান করেছে ১৩৪ কোটি টাকা।

এদিকে, পুঁজিবাজার উন্নয়ন এবং তারল্য প্রবাহ স্থিতিশীল রাখতে ২০১৮-২০১৯ হিসাব বছরে আইসিবির সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে কর্মসম্পাদন চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি আইসিবি। আইসিবির ৫টি মূলনীতির মধ্যে রয়েছে- পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, সরবরাহ বৃদ্ধি এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, সঞ্চয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং ব্যবসায়িক উন্নয়নে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা।

এ বিষয় জানতে চাইলে অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় আইসিবির বড় ধরনের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। বাজারের স্বার্থে আইসিবির বাজারে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যই আইসিবির জন্ম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর নিজের মুনাফা বাড়াতে ব্যস্ত থাকে। তারা পুঁজিবাজারে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরম ক্ষুব্ধ। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিকে বিনিয়োগে আসতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে কত টাকা বিনিয়োগ করেছে এটিও প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

স¤প্রতি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের পুঁজিবাজারবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এমডি ও সিইও মো. রিয়াদ মতিন বলেন, বাজারের এ অবস্থায় এখন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পোর্টফোলিও খারাপ অবস্থানে রয়েছে।

মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোও সংকটে রয়েছে। আবার পুঁজিবাজারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আইসিবি। বাজার যখন খারাপের দিকে যায় তখন একে স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব আইসিবির। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে আইসিবির বড় একটি ভূমিকা রয়েছে, কারণ আইসিবি একাই ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করে। কিন্তু কেন তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইসিবির মাধ্যমে বাজারের নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ খেলোয়াড়দের হাতেই। তাই আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব পালনে কতটুকু সফল তা পর্যালোচনার বিষয়। তাছাড়া আইসিবিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য। বাজার যখন নিন্মগতির দিকে থাকবে, তখন তাকে স্থিতিশীল রাখা আইসিবির দায়িত্ব। কিন্তু আইসিবি সেটি না করে শুধু শেয়ার বিক্রি করে কিন্তু এই শেয়ার বিক্রির টাকা কোথায় যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।

অন্যদিকে, বাজার ভালো না হওয়ায় বড় লোকসানে পড়েছে আইসিবি। মুনাফার পরিবর্তে চলতি অর্থ-বছরের তিন মাসের হিসাবে লোকসান করেছে ১৩৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থ-বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসের প্রথম প্রান্তিকের হিসাব প্রকাশ করেছে আইসিবি। এতে দেখা যায়, বছরের প্রথম তিন মাসে আইসিবির লোকসান হয়েছে ১৩৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আগের বছর একই সময়ে মুনাফায় ছিল আইসিবি। ওই বছরের প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা হয়েছিল ২৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

সেই হিসাবে এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা তো হয়ইনি, বরং লোকসান বেড়ে গেছে প্রায় পাঁচ গুণ। এদিকে, ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীরই প্রত্যাশা ছিল নতুন বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ভালো হবে। কিন্তু তার বদলে বড় পতন হয়েছে বাজারে। এই অবস্থায় ফের রাস্তায় নেমেছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা। বুধবার মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ করেছেন তারা। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পাঁচ সদস্যের কমিটিও করেছে সরকার।

২০১০ সালে বড় ধসের পর পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ‘খারাপ’ অবস্থা গেছে ২০১৯ সাল। ২০১০-এর ধসের পর ২০১৬ সালের শেষদিকে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। ২০১৭ সাল ভালোই গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে আবার পতন শুরু হয় পুঁজিবাজারে।

২০১৯ সালে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও তা স্থায়ী হয়নি। পতনের ধাক্কায় বাজার একেবারে তলানিতে নেমে যায়। সেই মন্দার কবল থেকে বের হতে পারছে না বাজার। টানা পতনে এক বছরের মধ্যে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমতে কমতে চার বছর আগের অবস্থানে চলে গেছে।