দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করতে গিয়ে চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনােলজিস্টসহ সেবাদানকারীরা আশঙ্কাজনকভাবে করােনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশে এখন পর্যন্ত ৬৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছে।

এর মধ্যে ২৯৫ জন চিকিৎসক, ১১৬ জন নার্স ও ২৪৯ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। এই তথ্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসম্পন্ন সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব, লক্ষণবিহীন রোগীদের সেবা প্রদান, আবাসন ও খাদ্যের সুব্যবস্থার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের হার বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন হেল্প বুলেটিনে ব্রিফিংকালে সোমবার অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করানোভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট পাঁচ হাজার ৯১৩ জন আক্রান্ত এবং ১৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫০ হাজার ৪০১টি।

বিএমএ মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী জানান, তাদের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে মোট আক্রান্তের ১১ শতাংশই চিকিৎসক-নার্স টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবাদানকারীরা এ হারে আক্রান্ত হতে থাকলে আগামীতে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএমএর তিন দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই।

দাবিগুলো হচ্ছে- দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড হাসপাতালে নিয়ােজিত চিকিৎসক-নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সঠিক মানের পিপিই, এন-৯৫ বা এর সমমানের মাস্ক প্রদান, নন কোভিড হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে ট্রায়াজ সিস্টেম চালু করে সেখানে কর্মরত সকল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য উপযুক্ত পিপিই, এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক প্রদান নিশ্চিত করা এবং সকল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসন, প্রয়ােজনীয় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ২৯৫ উল্লেখ করলেও বেসরকারি সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর) সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত দেশে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ৩৮৭ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত চিকিৎসকদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজধানীসহ ৩১৭ জন ঢাকা বিভাগের। এছাড়া বরিশালে ৯ জন, চট্টগ্রামে ১৫ জন, সিলেটে ৫ জন, খুলনায় ১০ জন, রংপুরে ৩ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ২৮ জন রয়েছেন বলে তারা জানায়।

এছাড়া সোসাইটি ফর নার্সের সেফটি অ্যান্ড রাইটস নামক একটি বেসরকারি সংগঠনের ২৪ এপ্রিলের তথ্য অনুসারে রাজধানীসহ সারাদেশে ১৭৮ নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১১৪ জন ও বেসরকারি হাসপাতালের ৬৪ জন। ওই সময় পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৫৬ জন, বরিশাল ৪ জন, সিলেটে ১ জন, ময়মনসিংহ ১৪ জন ও রংপুরে ৩ জন আক্রান্ত হন।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএমএ সরকারের প্রতি তিনটি প্রস্তাবনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। ১. দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোভিড হাসপাতালে নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সঠিক মানের পিপিই, এন-৯৫ বা এর সমমানের মাস্ক প্রদান ।

২. নন কোভিড হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে ট্রায়াজ সিস্টেম চালু করে সেখানে কর্মরত সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত পিপিই, এন-৯৫ বা সমমানের মাস্ক প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ৩. সব সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসন, প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ, হাসপাতালে যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক্সরে বিভাগের দু’জন টেকনোলজিস্টসহ মোট ৫ জন করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়েছেন। এতে এক্সরে বিভাগের কার্যক্রম বন্ধের পথে। আক্রান্ত একজন টেকনোলজিস্ট জানিয়েছেন করোনা আক্রান্ত কিন্তু কোনো লক্ষণ নেই এমন রোগীদের সেবা দিতে গিয়েই তারা আক্রান্ত হয়েছেন। এতে ওই বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের একজন চিকিৎসক, তিনজন নার্স, একজন ওয়ার্ড মাস্টার এবং পরিচালকের দফতরে কর্মরত একজন অফিস সহকারী ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া আরও অনেক স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারেন্টিনে আছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সম্প্রতি হৃদরোগ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত সাতজন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন।

যাদের মধ্যে দু’জন কেবিনে ছিলেন এবং বাকিরা ওয়ার্ডে ও করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব রোগীর মধ্যেও করোনার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। কিন্তু তিনজন রোগীর শরীরে গুরুত্বপূর্ণ শল্য চিকিৎসা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে করোনা পরীক্ষা করে পজেটিভ পাওয়া যায়। এরপর কোভিড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে হাসপাতালের অন্যান্য রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।

সোমবার শেরপুর জেলার সদর হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও তিন স্বাস্থ্যকর্মীর করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্ত তিন স্বাস্থ্যকর্মীই করোনার নমুনা সংগ্রহ দলে কাজ করতেন। নতুন শনাক্ত হওয়া তিন স্বাস্থ্যকর্মীর একজন জেলা সদর হাসপাতালের এবং দু’জন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জেলা সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান।

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা বলেন, এ পর্যন্ত ২৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। লক্ষণহীন রোগী এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তারা আক্রান্ত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, এভাবে টেকনোলজিস্ট আক্রান্ত হতে থাকলে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ যেমন বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি হাসপাতালগুলোর ল্যাবরেটরি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়বে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি আরও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ এবং তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী দেয়ার দাবি জানান।