এফ জাহান ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩১ কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। বড় কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারলেও ছোট কোম্পানিগুলো লড়াই করে টিকে আছে। এছাড়া কিছু কিছু কোম্পানির পরিচালকদেও বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। পাশাপাশি কোম্পানির পরিচালকদের বিরুদ্ধে সচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। নানামুখী কারনে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ওষুধ ও রসায়ন খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩১ কোম্পানির মধ্যে ১৯ কোম্পানির শেয়ারে বিদেশী বিনিয়োগ নেই।

বাকি ১২ কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে ৩ কোম্পানিতে বড় বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে ৯ কোম্পানিতে বিদেশী বিনিয়োগ থাকলেও নামমাত্র। এর মধ্যে লোকসানের পড়েছে তিনটি। আরও ১১টির মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমে গেছে। একটির সম্পদমূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। আরও পাঁচটির সম্পদমূল্য গত বছরের তুলনায় কমে গেছে।

ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে দুটির। এ চিত্র দেশে ব্যবসা করা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর। প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্রই বলে দিচ্ছে তারা খুব একটা ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) তাদের ব্যবসায় আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে বড় বা সুদের সঙ্গে ব্যবসা করা ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ঠিকই বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

মহামারিও তাদের সেই প্রবৃদ্ধি রুখতে পারেনি। ওষুধ হচ্ছে সেনসিটিভ পণ্য। সুতরাং জেনেশুনে কেউ খারাপ কোম্পানির ওষুধ কিনবে না। যে কারণে ভালো কোম্পানিগুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো মুনাফা করছে। অপরদিকে ছোট কোম্পানিগুলোকে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, রেনেটা লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার, মেরিকো বাংলাদেশ, একমি ল্যাবরেটরিজ স্ব-মহিমায় তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। ভালো মুনাফা করার পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর সম্পদ মূল্যও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। দেশের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার। করোনার মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর এই নয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৯১ টাকা ৪৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬৭ টাকা ৯৬ পয়সা।

সে হিসাবে মহামারির মধ্যেও আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা বেড়েছে ২৩ টাকা ৪৮ পয়সা। মুনাফার পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে যেখানে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ৭৯ টাকা ৫৮ পয়সা, তা বেড়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৮ পয়সা। দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা আরও একটি বহুজাতিক কোম্পানি মেরিকো বাংলাদেশও মুনাফার দিক থেকে পিছিয়ে নেই।

২০২০ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বর এই নয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৭৯ টাকা ৩৫ পয়সা, যা আগে বছরের একই সময়ে ছিল ৬৭ টাকা ৮৮ পয়সা। মুনাফার পাশাপাশি এই কোম্পানিটিরও সম্পদমূল্য আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ৪৪ টাকা ৫ পয়সা, যা ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৫৩ টাকা ২৫ পয়সা।

অন্যান্য খাতের মতো ওষুধ খাতও করোনার মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে সাপ্লাই চেইনে সমস্যা হয়েছে। তবে আমরা নিজেদের মতো সবকিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি।

ওষুধ ও রসায়ন খাতের দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে শেয়ারপ্রতি মুনাফার দিক থেকে সবার ওপরে রয়েছে রেনেটা। ২০২০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২৪ টাকা ৬৩ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২০ টাকা ৪০ পয়সা। অপরদিকে ২০২০ সালের জুনে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ২৩২ টাকা ৩২ পয়সা, যা ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২৩৬ টাকা ৪৬ পয়সা।

সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা দেশীয় কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ২০২০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৮ টাকা ৭৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭ টাকা ৭৭ পয়সা। মুনাফার পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদমূল্যেও বড় উত্থান হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৯২ টাকা ৪৭ পয়সা, যা জুনে ছিল ৮৭ টাকা ২৮ পয়সা।

নিয়মিত বড় মুনাফা করা আরেক কোম্পানি ইবনে সিনাও করোনা মহামারির মধ্যে বড় মুনাফা করেছে। ২০২০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮ টাকা ১৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭ টাকা ৩০ পয়সা। মুনাফার সঙ্গে এ কোম্পানিটিরও সম্পদমূল্য বেড়েছে।

গত বছরের জুনে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ ছিল ছিল ৫৬ টাকা ৮৮ পয়সা, যা ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৬১ টাকা ২৩ পয়সা। বড় কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও এক ডজনের বেশি কোম্পানির মুনাফা কমে গেছে। এর মধ্যে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে একাধিক কোম্পানির জন্য।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো সিনথেটিক। ২০২০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১ টাকা ৩২ পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১ টাকা ৪০ পয়সা। লোকসানের পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদমূল্যও ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে ক্যাশ ফ্লো। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ টাকা ৭২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা ৪০ পয়সা।

অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে কোম্পানিটির লোকসানের পাল্লা ভারি হয়েছে। অপরদিকে শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১ টাকা ৩২ পয়সা। অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হওয়ায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। লোকসানের মধ্যে পড়া অপর দুই কোম্পানির মধ্যে ইমাম বাটন ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৫১ পয়সা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ২৯ পয়সা।

লোকসানের পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদমূল্যও কমেছে। সেই সঙ্গে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে ক্যাশ ফ্লো। ২০২০ সালের মার্চ শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৮১ পয়সা, যা ২০১৯ সালের জুনে ছিল ৫ টাকা ৩২ পয়সা। অপর প্রতিষ্ঠান ফার কেমিক্যাল ২০২০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ৩ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৩৬ পয়সা মুনাফা করে। লোকসানের পাশাপাশি এই কোম্পানিটিরও সম্পদমূল্য কমে গেছে।

ডিসেম্বর শেষে ফার কেমিক্যালের শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা ৯৪ পয়সা, যা জুনে ছিল ১৩ টাকা ৯৬ পয়সা। অপরদিকে মুনাফা করলেও অ্যাকটিভ ফাইন, অ্যাডভেন্ট ফার্মা, এমবি ফার্মা, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, ওরিয়ন ইনফিউশন, ওরিয়ন ফার্মা, ফার্মা এইড, সিলকো ফার্মা, সিলভা ফার্মা ও ওয়াটা কেমিক্যালের শেয়ারপ্রতি মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এছাড়া লিব্রা ইনফিউশন ও কেয়া কসমেটিকের তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ওষুধ হলো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই ভালো কোম্পানিগুলোর ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাছাড়া ওষুধ হচ্ছে সেনসিটিভ পণ্য। সুতরাং জেনেশুনে কেউ খারাপ কোম্পানির ওষুধ কিনবে না। যে কারণে ভালো কোম্পানিগুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো মুনাফা করছে। অপরদিকে ছোট কোম্পানিগুলোকে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।

রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব নাজমুল আরিফিন বলেন, ক্রেতারা কেন আমাদের পণ্য পছন্দ করেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা পণ্যের মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করি না। আমরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, আমাদের মান মেইন্টেন করে চলতে হয়। আমাদের ইন্টারনাল রেজুলেশন আছে, সেগুলো মেনে চলতে হয়। পণ্যের মান ভালো না থাকলে, ক্রেতা থাকবে না। কাল যদি আমাদের থেকে একটা ভালো পণ্য আসে, তাহলে ক্রেতা সেখানে চলে যাবে।

ইবনে সিনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স আমিমুল ইহসান বলেন, অন্যান্য খাতের মতো ওষুধ খাতও করোনার মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে সাপ্লাই চেইনে সমস্যা হয়েছে। তবে আমরা নিজেদের মতো সবকিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি। আমাদের মুনাফায় যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তার চেয়ে ভালো মুনাফা হতো বলে আমাদের ধারণা।

সিলকো ফার্মার কোম্পানি সচিব টিংকু রঞ্জন সরকার বলেন, করোনার কারণে আমরা বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়ি। আমরা হলাম ডাক্তার বেইজ। ডাক্তার হলো আমাদের প্রথম কাস্টমার। ডাক্তাররা তো চেম্বারে বসতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে আমরা পলিসি পরিবর্তন করে গ্রামের ডাক্তারকে টার্গেট করি। আমরা প্রতিষ্ঠান ঠিক রাখার জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করেছি।

জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ তারেক হুসাইন খান বলেন, আমাদের কোম্পানি সরাসরি কোভিডের সঙ্গে জড়িত বিধায় বিক্রি, মুনাফা বেড়েছে। নরমালি মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়নি, তাহলে মেডিকেল ও সার্জিক্যাল ডিভাইস বিক্রি হবে। ওই হিসেবে সবারই ব্যবসা কমার কথা এবং কমেছেও।